MatiharMatihar

    Subscribe to Updates

    Get the latest creative news from FooBar about art, design and business.

    What's Hot

    পুনর্জীবনে ফিরে ॥ নাসরীন জাহান

    মার্চ ১৪, ২০২৫

    জীবিত ও মৃত: রবীন্দ্রদৃষ্টিতে সমাজে নারীর অবস্থান ॥ জান্নাতুল যূথী

    জানুয়ারি ২১, ২০২৫

    বামিহাল সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ পাচ্ছেন ৭ জন

    ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
    Facebook Twitter Instagram
    MatiharMatihar
    • প্রচ্ছদ
    • প্রবন্ধ
    • উপন্যাস
    • ছোটগল্প
    • কবিতা
    • গান
    • সাক্ষাৎকার
    • সমাজচিন্তা
    • অন্যান্য
      • দুস্প্রাপ্য রচনা
      • শিশুসাহিত্য
    Facebook Twitter Instagram
    MatiharMatihar
    Home»ছোটগল্প»মইওর বিবির ময়ূর ॥ সাদিয়া সুলতানা
    ছোটগল্প

    মইওর বিবির ময়ূর ॥ সাদিয়া সুলতানা

    মার্চ ৯, ২০২৩
    Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email
    Share
    Facebook Twitter LinkedIn Pinterest Email

    ১.
    দেখতে দেখতে ময়ূরটা কী করে পুরুষের আদলে বদলে গেলো মইওর বিবি জানে না। চোখে ধান্দা লেগে গেছে তার। শরীরে কাঁপন ধরেছে, হাড়ে হাড়ে ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। মইওর বিবির পায়ের হাড়গোড়ে এমনিতেই মড়মড়ানি ব্যথা। সে এখন ব্যথার কারণ সন্ধান করতে চায় না। এই মুহূর্তে সে ময়ূরের সন্ধানে আছে।

    রোম দাঁড়ানো কৌতূহলে মইওর বিবি লতা-পাতার ঝোঁপের আড়াল থেকে হাতিশূঁড়ের পুষ্পদণ্ডের মতো মাথা বের করে আছে। পেছন থেকে কলাপাতা রঙের শাড়িতে ঢাকা তার ঢেউ তোলা নিতম্ব দেখে মনে হচ্ছে এটি কোনো গাছের সুডৌল কাণ্ড। জঙ্গলমুখী হলে বেছে বেছে এই রঙের শাড়িই পরে মইওর বিবি। গাছগাছালি থেকে যেন তাকে আলাদা করা না যায় সেজন্য তার চেষ্টার কমতি থাকে না কোনো।

    এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাঁটুর ব্যথাটা ঝনঝনিয়ে উঠছে। গতকালও স্বামীর হাতে ধুপুরধাপুর মার খেয়েছে মইওর বিবি।

    পুবপাড়ার বড় মসজিদের মৌলভী সাহেব গত জুম্মাবারে দাওয়াত খেতে এসেছিলেন। পাতে ভাত তুলতে তুলতে তিনি পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো মইওর বিবির জোড়া পা লক্ষ্য করে বলেছেন, স্বামী স্ত্রীর শরীরের যেই অঙ্গে হাত তোলে সেই অঙ্গ বিনা কৈফিয়তে বেহেশতে যায়। ওসব কথা ছোটকালে মক্তবের ছোট হুজুরও বলতো। ওস্তাদের মার খেলে, ওস্তাদকে ধরতে দিলে ছাত্রীর শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ বিনা হিসাবে জান্নাতে যায়। এই জনমে যত মার খেয়েছে মইওর বিবি, তাতে তার পুরো শরীরই জান্নাতে যাওয়ার কথা।

    জান্নাত পাওয়া না পাওয়া নিয়ে অত মাথা ঘামায় না সে। দুই দুইটা সংসারে সন্তানসুখই পেলো না যে মানুষ, তার আবার জান্নাত পাওয়ার শখ থাকে নাকি? শখ থাকে তো কেবল বুড়ো মুকিমের মতো পুরুষমানুষের। নরম শরীর দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ো। রাতে বিছানায় তো দিনে উঠানে। কোনো বেলা বাদ যেতে দিবে না মানুষটা। আগের বউটা এই করে করেই তো মরল। প্রথম বউ দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের হাত ধরে পালিয়েছিল বলে পরের বার দেখেশুনে কচি মেয়ে বিয়ে করেছিল মুকিম। সে মেয়ে তখনো ছি কুতকুত খেলতো।

    মইওর বিবির বাপের বাড়ির তিন বাড়ি পরেই তাহেরাদের বাড়ি। বিয়ের দিন মইওর বিবিই শাড়ি পরিয়ে ছিল তাহেরাকে। শরীরই ফোটেনি মেয়ের, বুকে কেবল বকুল ফুলের গুটি এসেছে। দুই পেটিকোট পরিয়ে বিয়ের কণ্যাকে শাড়ি পরিয়ে ছিল মইওর বিবি। ভয়ে শিটকে লেগে ছিল মেয়ে। তা অত ছোট শরীর নেকড়ের থাবার সামনে দাঁড়াবে কী করে? প্রথম রাত থেকেই তাহেরার গোপনাঙ্গ দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়েছিল।

    আজিনা বলেছে, পাশের ঘর থেকে ও টের পেয়েছে, শয়তানটা উপগত হলেই ছোট শরীরটা আতংকে চেপে শক্ত হয়ে গেছে। দুর্গম সেই প্রবেশপথে শেষপর্যন্ত পুঁজ জমে গিয়েছিল।

    মুকিমের সেসব কীর্তি ফাঁস হয়নি। এসব লজ্জার কথা কি কাউকে বলা যায়? তবু কাহিনি পাঁচ কান হওয়ার ভয়ে কবিরাজ বাড়ি গিয়ে ওষুধ এনে তাহেরার চিকিৎসা করিয়েছে সে। এভাবে দিন বিশেক পার হলেও শেষরক্ষা হয়নি। মেয়েটা মরে গিয়ে বেঁচেছিল। এদিকে গ্রামে রটেছে মুকিমকে অসুইখ্যা মেয়ে গছিয়ে দিয়েছে তাহেরার বাপ। এসব কাহিনি বিশ্বাস করলেও মইওরের বাপ মেয়েকে মুকিমের ঘরে পাঠিয়েছিল। নয়তো কে বিয়ে করতো তালাকপ্রাপ্তা ধামড়ি মেয়েকে?

    মইওর বিবিও কম যায় না। এসব মারধরে গা করে না সে। মুকিম মারতে এলে পিছলে পিছলে যায়, খিস্তি-খেউড়ে একাকার করে। ‘হাড়গিলা শয়তান’ বললেই বাটিঘটি যা পায় হাতে নিয়ে কুঁদে মারতে আসে মুকিম। বেশিরভাগ সময়ই ব্যর্থ হয়। মাঝেমাঝে দুএকটা মার বেকায়কা লেগেও যায়। একদিন মারলে মইওর বিবি দুদিন শরীরে হাত দিতে দেয় না বুড়োকে। ইনিয়েবিনিয়ে দুল, চুড়ি কিনে এনে দরজা খোলায় বুড়ো। এরপর বুড়ো হাড়ের খেল দেখাতে গিয়ে দম যায় সুদের কারবারি মুকিমের। সেসব কথা মনে হতেই মইওর বিবির হাসি পায়। বুড়ো এখন হাত-পা চেগিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিবি কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে কোনো খবরই নেই।

    এদিকে সূর্য চোখ না মেলতেই ফরজ গোসল সেরে জঙ্গলে ঢুকেছে মইওর বিবি। সেই কখন থেকে নোনাধরা দেবমন্দিরের আশেপাশে উঁকিঝুঁকি মারছে।

    দুজনকে একসঙ্গে দেখলেই আজকাল তেতে ওঠে মুকিম, ‘দুই মাথা এক হইয়া শয়তানি বুদ্ধি করতাছে।

    কার্তিক মাসের মাঝামাঝি এখন। প্রথম সকালের হিম লেগে আছে পাতায় পাতায়। সূর্য ঠিকরে পড়া আলো গাছ-গাছালির শাখা-প্রশাখায় জাদুকরী বিভ্রম তৈরি করছে। সবে হিন্দুদের দূর্গা পূজা শেষ হয়েছে। এ মন্দিরে পূজা হয় না। আটিয়াটারির এই দিকটায় পরিত্যক্ত মন্দিরটা গা ছমছমে একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। মইওর বিবি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে কোন এক কালে অপঘাতে পুরোহিতসহ একাধিক দর্শনার্থী মারা গিয়েছিল। তখন থেকেই পূজা-আর্চনা বন্ধ এখানে। সচরাচর কেউ আসে না এদিকে। মইওর বিবি বিশেষ কারণে প্রতিদিন এখানে ঘুরঘুর করে।

    খসখস খসখস শব্দ হচ্ছে। সতর্ক হয় মইওর বিবি। আবার সবুজ রং ঘুরতে শুরু করেছে। ভুল দেখেছে সে। কোনো মানুষ না। এ ময়ূরই। সবুজ পালক ফুলে ফুলে উঠছে ময়ূরের। পেখম ছড়াবে কি? মইওর বিবি শুনেছে সঙ্গিনীকে না দেখলে পেখম ছড়াবে না পুরুষ ময়ূর। গাছের আড়াল ভেদ করে ডোরাকাটা রোদ পড়ছে ময়ূরের ওপর। চিকচিক করছে ওর মসৃণ শরীর। কাছেপিঠে কোথাও পাখি ডাকছে। সতর্ক হয়ে উঠছে প্রাণিটা। মইওর বিবিও সতর্ক হয়ে ওঠে। যে করেই হোক আজ সে দেখে নিবে শেষটা।

    ০২.
    বাড়ি ফিরে মইওর বিবি দেখে বিরাট গোল বেঁধেছে। মালসায় তোলা লবণ-হলুদে জ্বাল দেওয়া নলা মাছে বিড়াল মুখ দিয়েছে। মালসায় চাপা দেওয়া সরা কে সরালো তার কার্যকারণ খুঁজতে না খুঁজতেই বিবির দিকে তেড়ে আসে সুদখোর মুকিম।
    ‘অই ব্যাডা ঢলানি মাগী…সকাল সকাল কই গেছিলি। তোর বাপের কামাই খাইনি হ্যাঁ…মাগী তোর বাপের কামাই খাই? রক্ত-পানির কামাই আমার।’

    মইওর বিবির দিকে ছুটে আসা মালসা আছড়ে পড়ে মাটির উঠানে। মাছের হলুদ টুকরোগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। মাছের আধসিদ্ধ মাথা পা দিয়ে পিষে মাটিতে মিশিয়ে দিতে থাকে মুকিম। হৈ হৈ করে ঘর থেকে ছুটে আসে আজিনা।
    ‘অই খাওনের জিনিসে পা দ্যাছ কে তুই? রুটিরুজির বরকত থাকেনি?’
    আজিনা ছুটে এসে মাছের টুকরাগুলো তুলতে থাকে।
    ‘বরকত আছেনি এই সংসারে, ঐ বেটি যেইদিন পা দিছে এই বাড়িতে সেইদিন থেইকাই বরকত শ্যাষ। এক বিষ ঝাইড়া আরেক বিষ শইলে তুলছি। আইজই তোর বাপরে ডাকুম, যার মাল সে নিয়া যাক।’

    বাপের নাম শুনে আর স্থির থাকে না মইওর বিবি। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়া দেহ এক ঝটকায় ঝেড়ে তোলে। মুখে কিছু বলে না। বিবির দৃষ্টিতে ঘায়েল হতে থাকে মুকিম। এক ঝটকায় নিজেকে সামলে সে বড় ঘরের দরজায় পাশে দাঁড় করানো ডাঁশা হাতে নিয়ে তেড়ে যায় বিবির দিকে। এক ছুটে গিয়ে ভাইয়ের সামনে থেকে ভাবীকে সরিয়ে নেয় আজিনা। রাতভর জেগে সকালে বেহুঁশের মতো ঘুমিয়েছে আজিনা, রান্নাঘরে অনিষ্ট হচ্ছে টের পায়নি।
    ‘তোরও খুব বাড় বাড়ছে আজিনা। এই মাগীর লগে মিইশা তুইও একটা…।’

    আরও খানিকক্ষণ চোটপাট দেখিয়ে হাড়গিলা মুকিম বাড়ি থেকে বের হলে মইওর বিবি আজিনার কাছে ময়ূরের কথা পাড়ে। এ বাড়ি এসে আজিনার কাছ থেকেই ময়ূরের বৃত্তান্ত জেনে ছিল মইওর বিবি। প্রথম প্রথম বিশ্বাস করেনি। একদিন আজিনাও নাকি দেবমন্দিরের ময়ূরকে এক ঝলক দেখেছিল। দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেদিন কে ওকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিল তার রহস্যভেদ হয়নি আজও।

    এই এতটুকু গল্প এত লম্বা করে করে রোজ একবার শোনে মইওর বিবি। শরীরী কসরৎ সেরে বুড়ো ঘুমালেই বিছানা ছেড়ে সে আজিনার ছোট ঘরে ঢোকে। ছোটকালের গল্পের নেশা কাটেনি মইওর বিবির। বুজির কাছে চান সওদাগরের এক গল্পই শুনেছিল হাজারও বার। পান চিবানি মুখে বুজি গল্প বলতো আর চোখের পানিতে বালিশ ভেজাতো মইওর বিবি।
    হায়রে সে কী দুঃখ সওদাগরের ছোট বিবির! সতীনের হাত থেকে পানি খেয়ে পানির সঙ্গে সাপের বাচ্চা পেটে ঢুকেছিল ছোট বিবির। সেই সাপের বাচ্চা বড় হয়, ছোট বিবির পেটও বড় হয়। বাণিজ্য সেরে চান সওদাগর বাড়ি ফিরে অসতী অপবাদে ছোট বিবিকে ত্যাগ করে। ছোট বিবির দুঃখে বনের সব প্রাণী কেঁদে মরে। শেষ পর্যন্ত এক সবুজ ময়ূর ছোট বিবির সঙ্গী হয়। খুঁটে খুঁটে ছোট বিবির জন্য বীজ, ফল, শস্যদানা আনে। দু’হাতের আজলায় পোয়াতি ছোট বিবি শস্যদানা তোলে আর কেঁদে কেঁদে গান গায়,
    ও ও রে চান সওদাগর করলা তুমি কি,
    ভাইগ্যদোষে তাড়াইলা তুমি ঘরের লক্ষ্মী…।
    ছোট বিবির দুঃখে সবুজ ময়ূরের চোখেও দুঃখের অশ্রু ঝরে। দুঃখে দুঃখে কাটাকাটি হয়ে দুজনের মধ্যে গভীর ভাব হয়। একদিন ঘুমভাঙা সকালে ছোট বিবি দেখে; পাতার কুটিরে তার পাশে শুয়ে আছে অপূর্ব সুন্দর এক কুমার, ছোট বিবির পেটের ভার নেমে গেছে, পুরো বিছানায় ছড়িয়ে আছে মখমলি ময়ূর পালক।

    সবুজ ময়ূর দেখার লোভে মইওর বিবি আজিনাকে টানতে টানতে মন্দিরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আজিনা ওকে এগিয়ে দিয়েই পড়িমরি করে ছুটেছিল। আজিনা সবকিছুতেই এমন ভয় পায়। ভাইকেও ভয় পায়। আজকাল তবু মইওর বিবির কারণেই হঠাৎ হঠাৎ চোখ তুলে তাকায় ভাইয়ের দিকে। স্বামীর ঘর করতে পারেনি আজিনা, সতীনের মার খেয়ে ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছে তাই মন ছোট করে রাখে অহর্নিশি। মইওর বিবি ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ওর ভেতরে কোণঠাসা হওয়া মানুষটাকে জাগায়। দুজনকে একসঙ্গে দেখলেই আজকাল তেতে ওঠে মুকিম, ‘দুই মাথা এক হইয়া শয়তানি বুদ্ধি করতাছে।’
    ‘তুই তো গেলোি না। এই পরথম মইয়ূরের দেখা পাইলাম। কত যে সোন্দর!’

    তার আলুথালু চুলে, নগ্ন শরীরে সবুজ-সাদা রঙের ছোপ লেগে যাচ্ছে। কিছুই খেয়াল করছে না সে।

    বলতে বলতে চোখ বন্ধ করে অস্থির মইওর বিবি। চোখের সামনে দেখতে পায় দেবমন্দিরের সবুজ ময়ূর। ঘাড়-পিঠ বেয়ে যার সবুজ রং গলে পড়ছে। মুখের নীল-হলুদ চামড়া অদ্ভুত এক আলো খেলছে।
    ‘কী হইলো তোর?’
    আজিনার ধাক্কায় ধ্যান ভাঙে মইওর বিবির।
    ‘কাইল আরেকটু সকাল সকাল যামু।’
    ‘ভাই খবর পাইলে তোরে ছ্যাঁচবো।’
    ‘এমনিতে মনে কয় কম ছ্যাঁচে?’
    মাঝেমধ্যে মইওর বিবির ইচ্ছে করে বুড়ো হাড়গিলাটাকে মেরে ফেলে। শয়তানটার অন্ডকোষের ডগাটা সুপারি কাটার যাঁতি দিয়ে কাটে কচ করে কিংবা এক নম্বর ইট দিয়ে সেটা থেঁতলে দেয়। ভাবতে ভাবতে কোনদিন এর কোনো একটা কাজ করে ফেলে তার ঠিক নেই। এ কথা আজিনাকে বলতেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করে সে, ভাই মরবে সে কারণে না। রক্ত সহ্য করতে পারে না আজিনা। এমনকি মাছের রক্তও না। মুরগি জবাই দিলেও ঘরে গিয়ে দুয়ার দেয়।
    ‘বিষ খাওয়াইলে রক্ত বাইর হয় না।’
    আজিনার কথা শুনে মইওর বিবি হেসে গড়িয়ে পড়ে।
    ‘তুই তো একটা আস্ত শয়তান রে।’
    আজিনা কালো মাড়ি বের করে আকর্ণ হাসে।
    ‘আর তুই শয়তানের সই। আমার ভাইরে মারার শলা আমার লগেই করোস। ময়ূরের ঢক দেইখা দিশা নাই তোর।’
    এবার আরও রং চড়িয়ে আজিনাকে ময়ূরের রূপের বিবরণ শোনায় মইওর বিবি। প্রাণের সখী আজিনার কাছে সকালের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিলেও ভুলেও এক ঝলকে দেখা বিপুল সম্ভারের গোমর ভাঙে না সে।

    ৩.
    ঘুরে ঘুরে সুদাসল তুলে বাড়ি ফিরে এসে একদিন অসুখে পড়ে মুকিম। বিবির কাছে গোপন অসুখের কথা গোপন করলেও বিছানায় কাবু স্বামীর মুখের বাক্সময় যন্ত্রণা দেখে সব জেনে যায় মইওর বিবি। কালিঢালা অন্ধকার রাতে টাট্টিখানায় গিয়ে মাগো মা মাগো মা করে মুকিমকে কাতরাতে শুনে মইওর বিবির মনে ফুর্তি জাগে। এক নম্বর ইট দিয়ে হাড়গিলা শয়তানটার অন্ডকোষ থেঁতলে দেয়ার গোপন বাসনা অলক্ষ্যে পূরণ হতে দেখে মনে মনে তার আফসোসও হয়, কাজটা সে নিজের হাতে করতে পারলো না।

    সংসারের কাজকর্ম সেরে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায় মইওর বিবি। আজকাল শুধু চোখে না, ঘুম নামে তার শরীরজুড়ে। সব জ্বালা জুড়িয়ে গেছে, মাধুর্যে ডুবে গেছে রাতের নির্জনতা। মুকিমের বর্বর স্বর কান পর্যন্ত পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মন্ত্রবলে ঘুমিয়ে যায় মইওর বিবি।

    এমন সব উপভোগ্য রাত আর আসেনি তার জীবনে। সোনার কাঠি রূপার কাঠি অদল-বদল হলে রাত ফুরায়। মইওর বিবিও আত্মহারা হয়। আলুক্ষেতের আল ডিঙিয়ে ঘন হয়ে আসা গাছগাছালি, ঘাস, আগাছা পেরিয়ে মুকিমের নিকে করা বউ একাকী দেবমন্দিরের দিকে যায়। যখন বাড়িমুখো হয় মইওর বিবি, তার পায়ের আওয়াজও শোনা যায় না।

    আজও জীবন না মরণ কোনটা নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছে মইওর বিবি তা তার নিজের কাছেও অনির্ণীত থাকে। ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে বড় ঘরের বদলে ছোট ঘরে দুয়ার দেয় সে। পাশের ঘরে শুয়ে-বসে মুকিম কোঁকায়। শুভাকাক্সক্ষীরা বলেছে, কবিরাজি চিকিৎসায় কাজ হবে না। সদরে নিতে হবে। বিষয়টা নিয়ে মুকিমের সঙ্গে শলা করতে এসেছে এক বন্ধু। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আজিনাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে মইওর বিবি বাইরে আসে।

    লাফিয়ে লাফিয়ে বেলা উঠছে। তবু ঘরের কাজে মন নেই মইওর বিবির। ঘরবন্দী মুকিম সেই অপবাদ দিতে কোনো অবসর নেয় না।
    ‘ফুর্তি লাগছে মাগীর। একবার উইঠা খাড়াই। দিমু নে বিষদাঁত ভাইঙা।’
    দেখতে দেখতে মাস পেরিয়ে যায়। উঠে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আসে না মুকিমের। তাই নিয়ে বাড়ির অন্য দুইটি প্রাণীর কোনো ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। তারা দুই সখী একসঙ্গে খায়-দায়, পরস্পরের মাথার উকুন বাছে, রঙ্গরসিকতা করতে করতে একে-অপরের দেহে ঢলে পড়ে। শুধু ভোর হলেই মইওর বিবি একা হয়ে যায়। চুপচাপ বিছানা ছাড়ে। দিনে-রাতে এখন তার অখণ্ড অবসর, কেবল ভোরের সূর্য আকাশে ছড়িয়ে পড়ার আগের মুহূর্তটুকুতে তার ব্যস্ততার শেষ নেই। কী ঘোরে মইওর বিবি ময়ূরের খোঁজে ঘুরে বেড়ায় কেউ জানে না। সে নিজেও জানে না।

    আজ কার্তিকের শেষ। সূর্যের আলোর চক্র কেবল ঘুরতে শুরু করেছে। দেবমন্দিরের ভেজা দেয়ালে আলোর বিচ্ছুরণ হয়নি এখনো। মন্দিরের বাইরে সঘন সবুজে কম্পন দেখা যায়। আহারে…বুজির রূপকথা খুঁজতে খুঁজতে ওখানে মরতে গেছে মইওর বিবি। রূপকথার ময়ূর আজ নেমে এসেছে মাটিতে, মইওর বিবির সঙ্গে তার খুব ভাব হয়েছে।

    আজও চোখের নিমিষে ময়ূরটা পুরুষের আদলে বদলে গেছে। এমন সুঠাম দেহের পুরুষ কখনোই দেখেনি মইওর বিবি। ময়ূর পেখমের বেগুনি চক্র তার দুই চোখের মণিতে প্রতিফলিত হয়। পুরুষটি হাতের জোর বাড়াতেই মইওর বিবির শ্বাস-প্রশ্বাস গাঢ় হতে থাকে, সে ভুলে যায় সে মুকিম উদ্দিনের নিকে করা বউ। দেনমোহর পঞ্চাশ হাজার এক টাকা, এক হাজার টাকা মূল্যের নাকফুল ওয়াশিল।

    ডানার ঝাঁপ খুলে মইওরকে নিজের শরীরের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে সে। কোনো মানুষ ছোঁয় না তো যেন হাওয়া ছোঁয়। কার্তিকের হিম পাওয়া হাওয়া। আলিঙ্গনে জড়াতে জড়াতে মইওরকে তেজী সাপের মতো দংশন করে জোড়া পুরু ঠোঁট। মরে যাওয়ার বদলে গলে গলে যায় মইওর, বুকের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে শরীর ভাঙে। যেন সে কুমারী নারী, এর আগে কেউ স্পর্শ করেনি তাকে।

    দুজনের শরীরের ঘায়ে মন্দিরের দেয়াল ফুঁড়ে বের হওয়া লতাগুল্ম থেঁতলে যাচ্ছে। ক্ষীরই গাছের ডাটা ভেঙে দুধ বের হচ্ছে। মইওর বিবির খোঁপা ভেঙেছে। তার আলুথালু চুলে, নগ্ন শরীরে সবুজ-সাদা রঙের ছোপ লেগে যাচ্ছে। কিছুই খেয়াল করছে না সে।

    প্রশ্ন করে এবার আর উত্তরের অপেক্ষা করে না মইওর বিবি, তীরলাগা হরিণীর মতো জঙ্গলের দিকে ছুটতে থাকে।

    সবুজের দুর্গ ভেদ করে যখন মইওর বিবি বাড়ির পথ ধরে তখন মুকিম আজিনাকে বাগে পেয়ে চড়-থাপ্পড় মারছে। উঠানে পা দিয়ে দৃশ্যটা দেখে কী করবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় মইওর বিবি। রান্নাঘরে রাখা জলচৌকিটা তাকে নিশানা করে বিবিকে ছুঁড়তে দেখে মুকিম ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরের ভেতর ঢোকে।

    ‘আইজ থেইকা ভাত বন্ধ দুইটার। একটা টাকাও দিমু না আমি। নষ্ট মাইয়ামানুষ।’
    ‘তোর সুদের টাকা লইয়া কব্বরে যা হাড়গিলা শয়তান।’
    কবরের নাম শুনে যেন নিজের ধ্বজভঙ্গ অণ্ডডকোষের মতো চুপসে যায় মুকিমউদ্দিন। বড় ঘরের অন্তরালে থাকা বড় মানুষটার কণ্ঠনালি থেকে আর কোনো আওয়াজ বের হয় না।

    ৪.
    রাতে ভালো ঘুম হয়নি মইওর বিবির। মুকিম এমন কান্না জুড়েছিল যে অনেক চেষ্টা করেও দুচেখের পাতা এক করতে পারেনি মইওর বিবি। অন্ডথলির শিরা ফুলে গেছে মুকিমের। চিকিৎসা নিতে সদরেও যায়নি সে। কবিরাজ বাড়িতে ডেকে এনে দরজা বন্ধ করে কীসব চিকিৎসা নিচ্ছে। রাতে আজিনা ঘরের দরজায় কয়েকবার টোকা দিয়েছিল, দরজা খোলেনি মইওর বিবি। কয়েকদিন ধরে বড় ঘরের মেঝেতেই নিজের বিছানা পাতে সে। রাতে বিবিকে ঘরে না দেখলে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বিছানা থেকে নেমে বিবির গুষ্টি উদ্ধার করে। কাল রাতে এই শরীরেও বিবিকে চড়-থাপ্পড় মারার চেষ্টা করেছে। মইওর বিবিও ছেড়ে দেয়নি স্বামীকে। ঝগড়াঝাটি-মারামারির এক পর্যায়ে মুকিমের ব্যথার জায়গায় লাথি বসিয়েছে। লাথি সুবিধামতো না লাগলেও আতংকগ্রস্ত মুকিম কাঁদতে শুরু করেছিল।

    মইওর বিবির শ্রান্ত চোখে ঘুম নেমেছিল সুবহে সাদেকের সময়। ধড়ফড় করে উঠে দেখে বেলা গড়িয়েছে। সময় হারিয়ে ফেলার বেদনায় আহত পাখির মতো উঠানে দাঁড়িয়ে টের পেয়েছে আজিনার ঘরের দুয়ার আলগা।
    ‘ও আজিনা কই গেলো?’

    ডাক দিয়ে ঘাড় ঘুরাতেই দেখে পেছনে আজিনা দাঁড়িয়ে। মইওর বিবি চমকে যায়। তার হৃদপি-ের ভেতরে ভেতরে যোগ-বিয়োগের হিসেবের খেলা শুরু হয়। শ্যামলামুখী আজিনার গালে-কপালে কাঁচা সবুজ রং। চুলের মোড়া কচি দূর্বার পালক। দুচোখের পাপড়ি অহেতুক কম্পমান। মইওর বিবি চেষ্টা করেও আজিনার চোখে চোখ রাখতে পারে না। যতোটা ছটফট করে আজিনা সে ততোটাই স্থির থাকার চেষ্টা করে।
    ‘কই গেছিলি?’
    কথা ঘুরায় আজিনা। মুখে স্বভাবজাত আঁচল না চেপেই শব্দ করে হাসে। ওর হাসির শব্দ ছাপিয়ে মুকিমের ডাক-চিৎকার শোনা যায়।
    ‘ভাইয়ের কান্দন শুনছোস?’
    ‘শুনছি। তুই গেছিলি কই শুনি?’
    ‘কই যামু?’
    মুখের রেখা যথাসম্ভব টান টান করেও আজিনা হাসি লুকাতে পারে না। মইওর বিবির ভ্রু কুঁচকে ওঠে। এত সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিল আজিনা? অত হড়বড়ানি ভাব ক্যান ওর? ক্রোধ সম্বরণ করতে খানিকটা প্রস্তুতি নেয় মইওর বিবি। পরের প্রশ্নে যায় না। আজিনা ঘরে ঢুকে আলনায় ঝুলানো একটা শাড়ি টানে।
    ‘যাই। ডুব দিয়া আসি।’
    মাথার ভেতরে চিড়িক করে ওঠা গোস্বাটা থিতিয়ে আসে ক্রমশ। আজিনাকে মনোযোগ দিয়ে পরখ করে মইওর বিবি। হাবাগোবা অপবাদে যে আজিনার সংসার হয়নি আজ তার দুচোখ দেখে সে থতমত খেয়ে যায়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার। শ্বাস নেবার মতো বাতাস পায় না, এদিকে শরীরে বিঁধে যায় বাতাসের ফলা। বুকের ভেতরে গুমগুম করে ওঠা দহন জানান দেয়, পুনর্বার ঠকেছে সে। আড়ষ্ট জিভে কী জানতে চাইবে বুঝতে পারে না। আজিনাই নির্জনতা কেটে কথা আনে।
    ‘অই, তুই ভাইয়ের কারবার দেখছোস? নিজেই আইজ বঁটি বিছরাইতাছে। কী চিক্কুর পাড়তাছে দ্যাখ দ্যাখ।’
    আজিনার হাসিতে তরঙ্গ উছলায়। মইওর বিবি হাসে না। আজিনার পরনের সবুজ শাড়ির জমিনের ছাপ উল্টো। শরীর রঙে ঢলো ঢলো। দুচোখে অবাস্তব সুখের ছায়া। এবার আগুন জ্বলে ওঠে মইওর বিবির চোখে, ‘ফজরের ওক্তে কই গেছিলি কইলি না?’ প্রশ্ন করে এবার আর উত্তরের অপেক্ষা করে না মইওর বিবি, তীরলাগা হরিণীর মতো জঙ্গলের দিকে ছুটতে থাকে।

    সাদিয়া সুলতানা
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email

    সম্পর্কিত লেখা

    পুনর্জীবনে ফিরে ॥ নাসরীন জাহান

    মার্চ ১৪, ২০২৫

    ঠাকুরমার কেটলিটা

    মার্চ ৭, ২০২৪

    যাও ফিরে বৃষ্টি ॥ তানিয়া নাসরীন

    ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪

    Leave A Reply Cancel Reply

    সর্বশেষ প্রকাশিত

    দৃশ্যান্তের পর ॥ মাজরুল ইসলাম

    নভেম্বর ২৪, ২০২৩

    লিওনেল মেসি ॥ প্রিতময় সেন

    নভেম্বর ৬, ২০২৩

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-মন্বন্তর: নাট্যচর্চায় বিজন ভট্টাচার্য ॥ তপন মণ্ডল

    আগস্ট ৫, ২০২৩

    বসন্ত রাগ ॥ কালিদাস ভদ্র

    জুলাই ১৬, ২০২৩

    একাকীত্বের সব দহন তোমাকে দিলাম ॥ দীপংকর গৌতম

    জুলাই ৪, ২০২৩
    Stay In Touch
    • Facebook
    • Twitter
    • Pinterest
    • Instagram
    • YouTube
    • Vimeo
    Don't Miss

    পুনর্জীবনে ফিরে ॥ নাসরীন জাহান

    ছোটগল্প মার্চ ১৪, ২০২৫

    ফিসফিস ধ্বনি, এই বাড়িডা না? ধুস আওলা ঝাউলা লাগতাছে… লোকটার দুই পা ফেটে রক্ত ঝরছে।…

    জীবিত ও মৃত: রবীন্দ্রদৃষ্টিতে সমাজে নারীর অবস্থান ॥ জান্নাতুল যূথী

    জানুয়ারি ২১, ২০২৫

    বামিহাল সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ পাচ্ছেন ৭ জন

    ডিসেম্বর ২১, ২০২৪

    চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণ করলেন ৪ গুণীজন

    ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪

    Subscribe to Updates

    Get the latest creative news from SmartMag about art & design.

    সম্পাদক: জান্নাতুল যূথী ইমেইল: jannatuljuthi646@gmail.com

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.