গল্পের ভেতরে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানা গল্প জুড়ে দিয়ে, চমকে চমকে পাঠককে দিকভ্রান্ত করে তুললেই কি একটা শক্তিশালী গল্প নির্মাণ করা যায়? সামান্য পাঠক আমি; পাঠক হিসেবে মনে করি, কেবল অতিরঞ্জিত চমক নয়, কাহিনির ঠমক নয়, ভাষা দিয়ে আখ্যানকে এমনভাবে বেঁধে ফেলতে হয়, যেন শব্দের ক্ষরণ পাঠককে ভেঙেচুরে দেয়, রক্তাক্ত করে তোলে।
আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ও ঔপন্যাসিক ব্রেইতেনবাখের গদ্যের বই ‘ইনটিমেইট স্ট্রেঞ্জার’-এ একটি গদ্য আছে, যার শিরোনাম ‘পাঠক, সুরভিত পাঠক’ (অনুবাদক: এমদাদ রহমান) যেখানে ব্রেইতেনবাখ পাঠককে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘আমি শব্দের ভেতর দিয়ে তোমাকে আমার সংবেদনটুকুকে জানান দিচ্ছি, তোমাকে উসকে দেওয়ার এটাই আমার সবচেয়ে মোক্ষম পথ।’
কথাশিল্পী নাসরীন জাহান এভাবেই ক্রমাগত পাঠককে উসকে দেন। তিনি একজন সত্যিকারের শিল্পী; যিনি কঠিন পাথরে ছেনির ঠুকঠাকে ভাস্কর্য তৈরি করার মতো আখ্যান তৈরি করেন। কতটা নিপুণ, কতটা নিখুঁত হলো সেই নির্মাণ সেসব নিয়ে যেন খুব একটা ভাবনা নেই তার। তার যত মনোযোগ, যত ভাবনা কেবল নির্মিত কাঠামোর বৈচিত্র্য নিয়ে।
নাসরীন জাহানের ভাষাশৈলী তাই অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র। গল্পকে শব্দাকারে কেবল বইয়ের পাতায় আটকে ফেলা এই কথাসাহিত্যিকের লক্ষ্য নয়; তার লক্ষ্য শব্দকে ভেঙেচুরে নতুন নতুন সব আকৃতি দেওয়া। শব্দ নিয়ে দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে খেলেন তিনি। একমাত্র তিনিই পাঠককে দেখান শব্দের অঢেল সৌন্দর্য। একমাত্র তিনিই লেখেন রক্তক্ষত, জলবাতাস, পরিমিতিস্তর, বারান্দাআঁধার, আবেগজল, যীশু-অস্থিরতার মতো শব্দজোড়। আর তাই নাসরীন জাহানের ‘স্বর্গলোকের ঘোড়া’ আশি পৃষ্ঠার ছোট একটি উপন্যাস হলেও এর একেকটি শব্দ একেকটি বাক্য নিঙ্ড়ে সুধা বের করতে হয়।
কুশলী লেখকের পাঠকেরা আসলে কৌশল রপ্ত করে ফেলে, তারা জানে কী করে এমন লেখার সঙ্গে একাত্ম হতে হয়। নিজের পাঠরুচি নিয়ে তাই সামান্য উন্নাসিক হতে আমি কোনো ভুল করি না। বেশ কলরব করেই বলতে ভালোবাসি, এমন এক লেখকের আমি নিয়মিত পাঠক। আর অতীনের মতো আমিও বিশ্বাস করি, ‘আমাদের পাঠকরা, শ্রোতারা অনেক সরল, কোনো বিষয় যখন সত্যিকার শিল্প হয়ে ওঠে, তখন তারা এতো মুগ্ধ হয়, তার মধ্যে অশ্লীলতা আছে কি-না, জান্তব চিৎকার আছে কি-না, খোঁজে না। পৃথিবীজুড়ে বোদ্ধারাই বোদ্ধাদের শত্রু, শিল্পটা তারা হাড়ে হাড়ে বোঝে বলেই প্যাঁচ কষে ওর মধ্য থেকে দ্রুত বাজে গন্ধটা খুঁজে পায় এবং সেই গন্ধ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।’
কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের ‘স্বর্গলোকের ঘোড়া’ উপন্যাসের শুরুতেই আছে আখ্যানের সারসংক্ষেপ। আমি এর আশেপাশে না গিয়ে সোজা আখ্যানের প্রথম বাক্যে চলে যাই, ‘হে উত্তরীয় বায়ু, জাগো। হে দক্ষিণ বায়ু, আইসো। আমার উপবনে বহ, উপবনের বিবিধ সুগন্ধি প্রবাহিত হোক।’ অমন পরমগীত উপেক্ষা করি কী করে! বায়ুর গতি অনুসরণ করে তাই আমিও এগোই।
একসময় আমি হারিয়েও যাই, অতীনের ছেনির নিচে বুক-পিঠ পেতে দেওয়া পাথরে, নন্দিনীর স্মৃতির লৌকিক-অলৌকিক জলধিতে এবং মধ্যরাতের প্রিয় গ্রন্থ ‘স্বর্গলোকের ঘোড়া’য়।
নন্দিনী স্বর্গলোকের ঘোড়ার গল্প শোনাতে চায়, কিন্তু গল্পটা ছড়াতে চায় না, কোনো লেখকের কলমের খোঁচায় এই গল্পকে নিছক গল্প হিসেবে পাঠকের জন্য পাঠ উপযোগী করে তুলতে চায় না, তবু ওর গল্পটা একজন লেখকের কারণে শিল্প হয়ে যায় আর নন্দিনীকে যন্ত্রণাকর বেদনার ভেতরে ডুবিয়ে দেয়। বেদনাকে যদিও লিখতে পারেন অনেকে, সবাই বেদনাকে আঁকতে পারেন না। নাসরীন জাহান বেদনাকে লিখতে পারেন, আঁকতেও পারেন। আমি অনিঃশেষ বিস্ময় নিয়ে দেখেছি, তার হাতে পড়লে বেদনাও এক অবাক সুন্দর রঙিন ফিতে হয়ে যায়।
‘স্বর্গলোকের ঘোড়া’ উপন্যাসেও তা-ই হয়েছে। একজন স্বপ্নাক্রান্ত নারীর ক্রমাগত বলে যাওয়া কথন দিয়ে নির্মিত হয়েছে এই উপন্যাস। নন্দিনীই এই স্বপ্নাক্রান্ত নারী যার স্বপ্ন ছিল ডানাওয়ালা বোরাকের ঘোড়ায় চড়ে অসীম আসমানের স্বর্গে চলে যাবে। এই ঘোড়া যাকে যখন যেখানে নিয়ে যায় সময়ের ভেদ মুছে যায়। নন্দিনী ওর এই ডানাওয়ালা বোরাকের গল্পটা একজন নিবিষ্ট শ্রোতাকে শোনাতে চায়। মিস্টার এম. সেই শ্রোতা, সেই তৃতীয় ব্যক্তি যাকে নন্দিনী ওর এই গল্প শোনায়।
মিস্টার এমের সঙ্গে পাঠক আমিও ক্রমশ মনোযোগী শ্রোতা হয়ে উঠি। একজন নারীর অনর্গল বলে যাওয়া কথার সান্নিধ্যে ক্রমে অনুভব করতে থাকি প্রেম, শিল্প, মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষের ভঙ্গুর হওয়ার অবচেতন খেলার বিবিধ কৌশল। এজন্য আমাকে বিশেষ কসরত করতে হয় না, নন্দিনীই আমাকে সাহায্য করে। নন্দিনীই জানায় ওর প্রেমিক অতীন সম্পর্কের প্রগাঢ়তার মধ্যে কোনো শর্ত জুড়তে চায় না। নাসরীন জাহান কলমের শক্তিতে যেসব নারীকে নির্মাণ করেন, সে যেন এই সমাজের আর দশটা নারীর মতো হয় না, একেবারেই গতানুগতিক মানুষ হয় না। তার ভাবনা, তার দর্শন, অভিব্যক্তির সৌকর্য অন্য সবার চেয়ে আলাদা হয়, তাই নন্দিনী যখন বলে ওকে বিয়ে না করলে নন্দিনী আর জাগতিক পৃথিবীতে অতীনকে চিনবে না তখন অতীনের মতো আমিও বিহ্বল হই। আবার সেই বিহ্বলতা কেটে যায় যখন অতীনের বিয়ের সিদ্ধান্তে না যাওয়ার নেপথ্যের কারণ জানতে পারি আর উপলব্ধি করি ওদের সম্পর্কটা এমন শর্তহীন থাকে বলেই বুঝি কেউ কারো জীবনে অতীত হয়ে যায় না।
স্বর্গলোকের ঘোড়ার গল্পের সমাপ্তিরেখায় পৌঁছাতে হলে একে একে অতীনের গল্প, সুশোভনার গল্পকে অতিক্রম করতে হয়, জুড়তে হয় ওদের একসময়ের দিনযাপনের খণ্ড খণ্ড সময়। তাড়া নেই বলে আমি মিস্টার এমের মতো ধীরেসুস্থে নন্দিনীর গল্প শুনি, খেই হারানো নন্দিনীকে কোনো তাগিদও দিই না। কারণ আমি জানি, ও যা শোনাতে চায়, বহু পথ ঘুরে হলেও ও সেখানে শ্রোতাকে পৌঁছে দিবেই দিবে। সেই বিশ্বাস থেকেই আমি স্বর্গলোকের ঘোড়ার পিছু ছুটি। ছুটতে ছুটতে উপলব্ধি করি, ‘যেভাবেই হোক, পাথরে হোক, জলে হোক এবং মধ্যরাতের প্রিয় গ্রন্থে হলেও নিজেকে হারানো দরকার।’ একসময় আমি হারিয়েও যাই, অতীনের ছেনির নিচে বুক-পিঠ পেতে দেওয়া পাথরে, নন্দিনীর স্মৃতির লৌকিক-অলৌকিক জলধিতে এবং মধ্যরাতের প্রিয় গ্রন্থ ‘স্বর্গলোকের ঘোড়া’য়।