০১.
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষের বৈপ্লবিক ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্বের সর্বপ্রধান নায়ক ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)। তিনি বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনকে একত্রিত করে, তার নেতৃত্ব নিজে গ্রহণ করে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংগঠিত সশস্ত্র বিপ্লবের নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। নিজের পারিবারিক জীবন, উচ্চশিক্ষা লাভ সব তুচ্ছ করে দেশের মুক্তিই তাঁর কাছে সর্ববৃহৎ স্বার্থে পরিণত হয়। জার্মানি থেকে অস্ত্র-অর্থ সাহায্য আনার সব ব্যবস্থা তিনি করেন। তিনি অনুধাবন করেন ব্রিটিশকে ভারতের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি উদ্যোগও গ্রহণ করেন। ব্রিটিশবাহিনীর সঙ্গে অপরিকল্পিত ও অসম যুদ্ধে বাঘা যতীন নিজের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও, পালিয়ে যাবার সুযোগ ও অনুরোধ থাকা সত্ত্বেও, মরণযুদ্ধকেই তিনি গ্রহণ করেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। দৃঢ়চিত্তে বলেন, ‘আমরা মরব, দেশ জাগবে’। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য রক্তসোপানে জীবনদান মন্ত্রই সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে উঠেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁরই সৃষ্ট-পথে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ব্যাপকতর রূপ লাভ করে। সেই পথেই অর্জিত হয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা।
ভারতবর্ষের জাতীয় জাগরণের একটি বিশেষ সময়কে চিত্রিত করার মুহূর্তে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) সে-যুগের প্রতীকরূপে শিক্ষাসংগঠক ও বাঙালি সমাজসংস্কারক রামতনু লাহিড়ি (১৮১৩-১৮৯৮)কে নির্বাচন করেন। সে সময় বাগ্মিতায়, রচনাশৈলীতে, মননের উৎকর্ষে আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তারপরও রামতনু লাহিড়িকে কেন তিনি সে-যুগের প্রতীকরূপে অভিহিত করেছিলেন, তাঁর কারণ হলো, তাঁর চরিত্রে বাংলার তাজা প্রাণ ও পরিশীলিত বুদ্ধির যে সমন্বয় ঘটেছিল তা ছিল অভাবনীয়। এ কারণেই অন্যদের থেকে রামতনু লাহিড়ি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
কয়েক দশক পরে সেই জাগরণ রীতিমতো অভ্যুত্থানে পরিণত হয়, যার প্রধান পুরুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) ও শ্রী অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০)-এর মতো বিস্ময় প্রতিভা। কিন্তু সমগ্র আন্দোলনটির প্রতীকরূপে অনেকেই চিহ্নিত করেছেন বাঘা যতীন (১৮৭৯-১৯১৫)কে- তাঁর মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় একটি যুগ বাংলার বিপ্লবী সংগঠনকে তিনি প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে, ব্রিটিশবাহিনীর সঙ্গে প্রথম সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধ করে আত্মাহুতি দেন, সেই মৃত্যুর ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা লাভের প্রকৃত মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করেন। তাঁর সেই প্রেরণা অব্যাহত ছিল স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত। দেশের মুক্তির অনিবার্য পথ হিসেবে বাঘা যতীনের প্রবর্তিত বিপ্লবী সশস্ত্র কর্মপন্থাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। প্রথম বিশ^যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র বলে পরিচিত ‘জার্মান প্লট’ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল। বিপ্লবী বাঘা যতীন ১৯১৫ সালের ০৯ সেপ্টেম্বর বালেশ্বরে ব্রিটিশদের সৈন্যবাহিনীর সাথে অসম এক যুদ্ধে পেটে ও বগলে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রচন্ড আহত হয়ে ববন্দি হন। ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে উড়িষ্যার বালাসোর হাসপাতালে নিজের শরীরের সমস্ত ব্যান্ডেজ নিজে হাতে ছিঁড়ে আত্মাহুতি দেন। তখন তাঁর বয়স ৩৫ বছর। বাঘা যতীন এ কারণেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হয়ে-উঠতে পেরেছিলেন।
০২.
এরপর দীর্ঘকাল কেটে গেলেও এদেশে কখনও তাকে স্মরণ করা হয়নি। এমন কি তার জন্মভিটা কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামেও কখনও তাকে স্মরণ করা হয়নি। এক সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতিক ও বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা এ এস এম কামাল উদ্দিনের উদ্যোগে ২০১১ সালে মহান এই বিপ্লবীকে কয়ায় তার জন্মভিটায় আমরা প্রথম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। সে বছরই বছর ১০ সেপ্টেম্বর এ এস এম কামাল উদ্দিনের উদ্যোগে ও সহযোগিতায় মহান বিপ্লবীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আড়ম্বরপূর্ণভাবে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কুষ্টিয়ার সে সময়ে জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক, ঢাকা থেকে এ এস এম কামাল উদ্দিন ও তার সহধর্মিনী ফাতেমা কামাল এবং প্রখ্যাত অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ অনুষ্ঠানে অংশ উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে মানুষের যে ঢল নেমেছিল, তা আজও বিরল এক ঘটনা।
০৩.
কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে বাঘা যতীনের বাড়ি। বাবা-দাদার মুখে তার নাম শুনেছি। গল্প শুনেছি। তবে তা এক রত্তি। একা লড়াই করে একটা ভোজালি দিয়ে বাঘ মেরেছিলেন। আর নিজে ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এর বেশি শুনিনি। ছোটবেলায় যখন তার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটেছি, ভাঙা প্রাচীর, ইটখসা গেট দেখেছি। তখন এ বাড়িতে অন্যদের বসতি। তারও আগে অন্যরা বাস করতো। এই অন্যরা হলেন আফতাব কন্ট্রাক্টর ও তার ভাইয়েরা। তখনকার ধনী মানুষ। এরপর অহিরদ্দিন মালিথাদের বসতি গড়ে ওঠে এখানে। মুখে মুখে নামটা ঠিকই থেকে যায়, বাঘা যতীনের বাড়ি। বাড়িটা যে বাঘা যতীনের, তাও ঠিক নয়। এটা তার মামাদের বাড়ি। নানা ছিলেন বিশাল প্রভাবশীল ব্যক্তি। প্রচুর সম্পত্তির মালিক। নাম মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়। তার বাবা হরিসুন্দরও প্রভাবশীল ছিলেন। এলাকার প্রধান তারাই ছিলেন। বাঘা যতীন আসলে এ পরিবারের ভাগ্নে। শরৎশশী দেবীর সন্তান। তিনি এ বাড়িতেই জন্মেছিলেন।
বাঘা যতীনের দেশপ্রেম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লব গড়ে তোলা, যুদ্ধ করা, আত্মাহুতি দেয়া এসবের কিছুই কি বিখ্যাত এ ঔপন্যাসিকের মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
জন্মের পরে পাঁচ বছর বাবার বাড়ি ঝিনাইদহের সাধুরহাটির রিশখালি গ্রামে ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পরে তার বড় মামা বসন্তকুমার চ্যাটার্জি বোন ও ভাগ্নে-ভাগ্নিদের নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। অর্থাৎ কয়া গ্রামে। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে। এরপর থেকে তিনি কয়া গ্রামের সন্তান হয়ে ওঠেন। তার পরিচয় হয়ে ওঠে কয়া গ্রামের সন্তান। ‘কয়ার ভাগ্নে’ শব্দটা খসে ‘কয়ার সন্তান’ হয়ে ওঠেন তিনি। চ্যাটার্জি পরিবারের ভাগ্নে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ বাঘা যতীন চ্যাটার্জি পরিবারের সন্তান হয়ে ওঠেন। তার নামেই বাড়ির পরিচিতিও পরিবর্তন হয়ে যায়। চ্যাটার্জিদের বাড়ি হয়ে যায় বাঘা যতীনের বাড়ি। কয়ার স্কুল-বাজার-গড়াই নদী দীঘল সবুজ মাঠ, সবকিছুতেই বাঘা যতীন মিশে একাত্ম হয়ে যান। এখানে একটু বলে রাখি, ভারতের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এ চ্যাটার্জি পরিবারের সন্তান। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় আর বাঘা যতীন আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই। আরও খোলাসা করে বলি, বাঘা যতীনের ছোট মামা সুসাহিত্যিক-বিপ্লবী-আইনজীবী ললিতকুমার চ্যাটার্জির নাতি ছেলে তিনি। ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় নিজেও বিপ্লবী ভাগ্নে বাঘা যতীনকে নিয়ে ‘বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থ লিখেছেন। ‘পারিবারিক স্মৃতি’ নামেও তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আছে। সেই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চ্যাটার্জি পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা এবং ঠাকুর-পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল-পারস্পরিক যাতায়াত ছিল সেসবেরও বর্ণনা রয়েছে। আর একটি তথ্য এখাণে উল্লেখ কওে রাখি, চ্যাটার্জি পরিবারের বড় সন্তান অর্থাৎ বাঘা যতীনের বড় মামা আইনজীবী বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত আইনজীবী ছিলেন।
০৪.
বাঘা যতীন মানুষটা খুব বিখ্যাত। কিন্তু ওটুকুই। গ্রামে শুধু নামটুকুই ভেসে বেড়ায়, আর কিছু নয়। গ্রামের মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে যে বিরাট গর্ব বা অহংকার আছে, তাও মনে হয়নি আগে। তবে এখন মনে হয়। কেন মনে হয়? আগে কেন মনে হয়নি? এসব প্রশ্ন তো নদীর ঢেউ খেলার মতো ওঠানামা করতেই পারে। করেও। সাথে আরও প্রশ্ন উঠতে পারে, বাঘা যতীনের বাড়ির ইট-পাথর দ্রুত কেন নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে? কিভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কারা এসব করেছে, কেন করেছে? বাড়িটা তো তারা বিক্রি করে চলে যাননি। চলে গিয়েছেন কৃষ্ণনগরে। সব তো ফেলেই রেখে গিয়েছিলেন। কিভাবে কারা কেমন করে এ বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়ে গেল? কিভাবে একের পর এক হাত বদল হলো? এসব কথাও তো আসতে পারে।
এসবই তো এক বিস্ময় প্রশ্নের পর প্রশ্ন। গড়াই নদীর ঢেউ যেমন মাথা উচু করে ওঠে, আবার আর এক ঢেউয়ে ডোবে। এ প্রশ্নগুলোও এখানে সে রকমই। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন এ গ্রামের আর এক বিখ্যাত সন্তান। তুমুল জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন। পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে তিনটা দশক তিনি বাংলাদেশের পাঠকদের নিজের পুরো দখলে রাখতে পেরেছিলেন। কম কথা নয়। তার কোন উপন্যাসে বা প্রবন্ধে বাঘা যতীনের নাম নেই। তিনি কোথাও তার নামটা উল্লেখ করেননি। বলেননি। কেন বলেননি এটাও তো একটা প্রশ্ন। এ প্রশ্নটাও তো ছোট নয়। বাঘা যতীনের মৃত্যুর দুই বছর পরে আকবর হোসেনের জন্ম। বাঘা যতীন আত্মাহুতি দিয়েছেন ১৯১৫ সালে ১০ সেপ্টেম্বরে। আকবর হোসেন জন্মেছেন ১৯১৭ সালের ১ অক্টোবরে। কয়া গ্রামেই তিনি বড় হয়েছেন। বাঘা যতীনের দেশপ্রেম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লব গড়ে তোলা, যুদ্ধ করা, আত্মাহুতি দেয়া এসবের কিছুই কি বিখ্যাত এ ঔপন্যাসিকের মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। দুই জনই তো একই গ্রামের সন্তান। কোন দায়বোধ কি তৈরি হয়নি নিজের গ্রামের এমন বিখ্যাত একজন সন্তানের জন্য?
আমাদের বাড়ি একই গ্রামে। তিনি অনেক খুশি হয়ে জানতে চাইলেন, বাঘা যতীন সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
আমার নিজের ভেতরে এ প্রশ্নগুলো এসেছে। উত্তর জানি না। তবে আর একটি বিষয়ও তো সামনে অঅনা যেতে পারে। আকবর হোসেনের প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়। এটি যখন রচিত হয় তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশশাসিত পরাধীন। তিনি এ উপন্যাস লিখেছিলেন ১৯৪০ সালের দিকে। যখন তিনি বিএ ক্লাসের ছাত্র। এ উপন্যাসে আকবর হোসেন খুব শক্তভাবে সচেতনভাবে স্বদেশি আন্দোলনের কথা বলেছেন। উপন্যাসে এ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী আমজাদ। যিনি নীতিবাচক চরিত্র থেকে স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হয়ে উপন্যাসের নায়ক ফিরোজের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত অর্থে নায়কের যে আলো বা গুরুত্ব তা আমজাদ হয়ে ওঠে। তাহলে আকবর হোসেন স্বদেশী আন্দোলনকে ধারণ করেছেন বোঝা যায়। এই সত্য যখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন প্রশ্ন আরো কঠিন হয়ে ওঠে আকবর হোসেনের জন্য, স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান নেতা বাঘা যতীন তাঁরই গ্রামের সন্তান। এমন কি বিখ্যাত চ্যাটার্জি পরিবারের ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নিয়ে তাঁর কোন লেখাতেই কোন কিছু পরিলক্ষিত হয় না। এসব ভাবনায় চলে আসে। বাঘা যতীন কেন তাঁর কাছে অবহেলিত অমূল্যায়িত অনুল্লিখিত থাকলেন? এ উত্তর মেলানো এখন কঠিন।
বাঘা যতীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন, যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন। এ রকম একটা বিষয় গ্রামের আর বিখ্যাত সন্তানের মধ্যে কেন প্রভাব ফেলেনি। বাঘা যতীন তো এসব উত্তরসূরীদের জন্যই দেশটা স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের চেতনায় কেন বাঘা যতীন আসেনি এসব চিন্তা চলে আসে। তখনও কি সাম্প্রদায়িক ব্যাপারটা এসব চিন্তাশীল মানুষদের মধ্যে কাজ করতো? উত্তর জানা নেই। কিন্তু প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্ব আসনে যারা একক চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, তাঁরাও বাঘা যতীনকে নিয়ে লিখেছেন। তার অবিশ্বাস্য রকম দেশপ্রেমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আরও বহু কবি-সাহিত্যিক তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। অথচ তারই গ্রামের বিখ্যাত আর এক সন্তান ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের কাছে তিনি ‘সাড়াশব্দহীন’ থেকে গেলেন। তার কলমে একটি শব্দও লেখা হলো না মহান এ বিপ্লবীকে নিয়ে। কেন যেন এসব এখন প্রশ্ন হয়ে মনের ভেতর বুদবুদ কর উঠছে।
০৫.
ব্রজেন বিশ্বাস নামে একজন রাজনীতিক ছিলেন কয়া গ্রামে। লোকাল রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তিনিও লিখতেন। কম লিখতেন। ‘মোহিনী মিল ও শ্রমিক আন্দোলন’ নামে তাঁর একটি পুস্তিকা আছে। তিনি জনসভায় ভাল বক্তৃতা করতেন। তিনিও তো বাঘা যতীনকে নিয়ে একটা কথা বলেননি। তাকে নিয়ে কোন স্মরণসভা করেননি। গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে বাঘা যতীনের আলোটা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেননি। তিনি কি মুসলমানদের ভয় করতেন? বাঘা যতীনের নাম বললে, বাঘে খেয়ে ফেলবে। অথচ সারাজীবন তিনি বাম রাজনীতি করেছেন, আদর্শের গল্প করেছেন, সাহসের কথা বলেছেন, আমাদের কাছেও কত জনের কত কাহিনী বলেছেন, বাঘা যতীনের কথা তো কখনও বলেননি।
নিজের গ্রামের বিখ্যাত সন্তানটির জীবন-ইতিহাস নিয়ে কোন দিন কিছু বললেন না, কিছুই লিখলেন। কেন লিখলেন না, কেন বললেন না, এ এক অদ্ভুত রহস্য! বাঘা যতীন হিন্দু-মুসলামানের কথা ভাবেননি। তিনি ভারতবর্ষের মুক্তির কথা ভেবেছেন, ভারতবর্ষের সব মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছেন, স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন। ভেবেই চুপ করে থাকেননি। আন্দোলন করেছেন, বিপ্লব করেছেন, যুগান্তর দলের প্রধান হয়েছেন, বিপ্লবীদের সংঘঠিত করেছেন, জার্মান শক্তির সাহায্য চেয়েছেন, সশস্ত্র বিপ্লব করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য তৈরি করবেন বলে। শেষে উড়িষ্যার বালেশ^রে হার-না মানা অসম এক যুদ্ধে নিজের জীবনটাই দিয়ে দিলেন। অনায়াসে যুদ্ধ না করে, পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করতে পারতেন। ভীরু কাপুরুষের মত তা করেননি। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এক পা তিনি পিছ পা হননি। বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু কওে যুদ্ধ করে, শরীরের প্রতিটি ফোটা রক্ত দেশের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করেছেন। অথচ তিনিই নিজের গ্রামে কী ভীষণভাবে উপেক্ষিত, অবহেলিত, অসম্মানিত।
০৬.
প্রায় দুই যুগ আগে আমার পরিচয় হয়, এক সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতিক, সমাজচিন্তক ও বিশিষ্ট শিল্পদ্যোক্তা এ এস এম কামাল উদ্দিনের সাথে। আমি তখন ঢাকায় জীবন-জীবিকার জন্য কঠিন যুদ্ধ করছি। একটি পাক্ষিক পত্রিকায় কাজ করি। আমার বাড়ি কুষ্টিয়া জেনে তিনি বললেন, বাঘা যতীনের বাড়িও তো কুষ্টিয়া। আমি খুব গর্ব করে তখন বললাম, হ্যাঁ বাঘা যতীনের গ্রামই তো আমার গ্রাম। আমাদের বাড়ি একই গ্রামে। তিনি অনেক খুশি হয়ে জানতে চাইলেন, বাঘা যতীন সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
আর কী আশ্চর্যভাবে সেই ‘সামান্য আলো’ অসামান্য হয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে বাঘা যতীনের নবজাগরণ ঘটে গেলো তাঁর গ্রামে, তাঁর কুষ্টিয়ায় তথা গোটা দেশে।
আমাদের গ্রামের সবাই বাঘা যতীন সম্পর্কে যতটুকু জানে, আমিও অতটুকুই জানি। তিনি এক রকম হতাশই হলেন। তিনি বাঘা যতীনের গল্প বললেন। তার জীবনের, বিপ্লবের বিভিন্ন ঘটনা বললেন, বাঘা যতীনকে নিয়ে অনেক বইপত্র আছে তাও জানালেন। তখন নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছিল, আমার নিজের গ্রামে এতো বড় বিখ্যাত একজন বিপ্লবীর জন্ম, বেড়ে ওঠা, যাকে নিয়ে গোটা ভারতবর্ষ গর্ব করে, আমরা তার নিজের গ্রামের সন্তান হয়ে কিছুই জানি না। সেই থেকে বাঘা যতীন সম্পর্কে জানতে শুরু করি। এর পর বিপ্লবী বাঘা যতীনের জন্ম, বেড়ে ওঠা, পারিবারিক জীবন, পড়ালেখা, বিপ্লবী জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। এবং একপর্যায়ে তা রীতিমতো গবেষণা কর্মে পরিণত হয় আমার। বাঘা যতীনকে যতই আবিষ্কার করতে থাকি ততই বিপুল বিস্ময় এসে আমাকে বিস্মিত করে, আপ্লত করে। ভীষণ গর্ব অনুভব করতে থাকি। দুই বছরের কঠোর সাধনায় বাঘা যতীনের জীবন ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ড নিয়ে ‘বিপ্লবী বাঘা যতীন’ গ্রন্থ রচনা করি। গ্রন্থটি জনাব এ এস এম কামাল উদ্দিন ও তাঁর সহধর্মিনী ফাতেমা কামালকে উৎসর্গ করি। এর পর এ বইটির এক আধুটু সংযোজন করে কওে আরো অন্য প্রকাশনী থেকেও প্রকাশ হয়েছে। শেষে ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন’ গ্রন্থ রচনা করি। সেটা ২০২০ সালে প্রকাশ পায়। গ্রন্থি সে বছরই ‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সাহিত্য পুরস্কার-২০২০’ অর্জন করে। এ সবের মূলে একজন এ এস এম কামাল উদ্দিনের অপরিসীম প্রেরণা কাজ করেছে।
এ এস এম কামাল উদ্দিনের উৎসাহ ও প্রেরণায় আমরা কয়া গ্রামে ২০১১ সালে প্রথম বাঘা যতীন স্মরণে অনুষ্ঠান করায় প্রয়াস গ্রহণ করি। নিজে কয়া গ্রামে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তিনি সানন্দে পরিবারসহ সেই অনুষ্ঠানে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তিনি সপরিবারে অনুষ্ঠানে এসেছেন। সাথে এলেন আমার বন্ধু আসাদুল ইসলাম আসাদ। টেক্সেল ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির চেয়ারম্যান। মেহেরপুরের সন্তান। সেই অনুষ্ঠানে এ এস এম কামাল উদ্দিন গ্রামের মানুষদের বললেন, বাঘা যতীনের কথা, বললেন- তার মহান আত্মত্যাগের কথা। সমস্ত মানুষ যেন নড়েচড়ে উঠলো, আমরা তো এসব কিছুই জানি না। তিনি বললেন, ‘বাঘ এখন নড়ছে। দেখবেন এক সময় বাঘ দৌঁড়াবে।’
সত্যি তাই হলো এর পরের বছর বাঘা যতীনের জন্মবার্ষিকী আয়োজনের প্রস্তুতি নিই। আমার বন্ধুরা এগিয়ে এলো, এক সাথে একই চেতনায়। অনেক মুরুব্বি এগিয়ে এলেন। তন্মধ্যে আমার বাবা মোহা. উকিল উদ্দিন শেখ, রাজনীতিক জালাল উদ্দিন খান, নাসিরউদ্দিন মাস্টার, জাবেদ আলী সহ আরো অনেক বিশিষ্টজন। বন্ধুদের মধ্যে শৈলেনকুমার ঘোষ, অধ্যক্ষ আবু সালেহ, রায়ডাঙার নজরুল, রানা, মিঠুন, ছোটভাই হামিদুল, মিলন হাসান ও অনুজতুল্য মহসীনসহ আরো অনেকেই। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আমরা বাঘা যতীন সম্পর্কে জানাতে চেষ্টা করলাম। বাঘা যতীনের জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে, জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক আসবেন। আগে তো কোন জেলা প্রশাসক এখানে এভাবে আসেননি। ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো সবার কাছে। ঢাকা থেকে আসবেন শিল্পোদ্যোক্তা-সমাজচিন্তক এ এস এম কামাল উদ্দিন, প্রখ্যাত অভিনেতা-লেখক খায়রুল আলম সবুজ আসবেন। গোটা এলাকা জুড়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেলো। বাঘা যতীনের বাড়িতে এই প্রথম মানুষের ঢল নেমে এলো তাকে সম্মান জানাতে-শ্রদ্ধা জানাতে। এ এস এম কামাল উদ্দিন বললেন, ‘আমি এর আগে একবার এসে আপনাদের বলেছিলাম, বাঘ এখন নড়ছে। দেখবেন এক সময় বাঘ দৌঁড়াবে। আজ কিন্তু বাঘ দৌড়াচ্ছে।’
সেই থেকে প্রতি বছর বাঘা যতীনের জন্মভিটায় তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন হয়ে আসছে। চট্টগ্রামের একজন মানুষ বাঘা যতীনের আলোটা ছড়িয়ে দিলেন, যে আলোটা ছড়াতে পারেন নি তার গ্রামের কেউ, এমনকি গোটা কুষ্টিয়ার কোন বিশিষ্টজন।
এখন বাঘের দৌড়ের গতি বেড়েছে। সেই দৌড়ে মন্ত্রী এমপি রাজনীতিক শিক্ষাবিদ সমাজসেবক কতোজনই তো যুক্ত হচ্ছেন কয়া গ্রামে বাঘা যতীনের ভিটেতে। এভাবেই বিপ্লব জেগে ওঠে, জেগে থাকে। শুধু কাউকে না-কাউকে আলোটা জ্বালিয়ে দিতে হয়, যেটা বাঘা যতীনের ক্ষেত্রে তাঁর গ্রামে আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন এ এস এম কামাল উদ্দিন। আর কী আশ্চর্যভাবে সেই ‘সামান্য আলো’ অসামান্য হয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে বাঘা যতীনের নবজাগরণ ঘটে গেলো তাঁর গ্রামে, তাঁর কুষ্টিয়ায় তথা গোটা দেশে।