ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা তখন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। কংগ্রেসের রাজনীতি তখন গান্ধিজির অহিংস, সত্যাগ্রহের ধারায় নিয়ন্ত্রিত। এই আন্দোলনের এতটাই প্রভাবিত করেছিল গোটা দেশবাসীকে যাতে মহিলারাও দলে দলে যোগ দিতে শুরু করেছিলেন। দেশের অন্যান্য প্রান্তের মত সিলেটের সাধারণ মহিলারা পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে চরকায় সুতো কাটতে শুরু করেছেন। চরকার সুতো ও খাদির কাপড় জড়িয়ে মহিলারা জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছেন।
জাতীয় কংগ্রেসের মহিলা সংগঠন হিসেবে তখন শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের কার্যকলাপ নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছে ব্রিটিশ রাজশক্তি। নরেশনন্দিনী দত্ত শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের অন্যতম নেত্রী। ১৯০২ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ঈষাণচন্দ্র গুপ্ত, মা- নিত্যময়ী গুপ্ত। দেশভাগের পর উত্তর ২৪ পরগণার উদ্বাস্তু নগরী অশোকনগর কালিবাড়ি মোড় সংলগ্ন ৩ নম্বর স্কিমের বাড়িতে শেষজীবন কাটিয়েছেন। অশোকনগরের নাগরিক জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে সভা-সমিতিতেও তাঁকে এক সময় প্রথম সারিতে দেখা গেলেও আজকের অশোকনগরে তিনি অনালোচিত, উপেক্ষিত ও বিস্মৃত। জানা যায়, তিনি ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে, ১৯৪১ ব্যক্তিগত সত্যাগ্ৰহে, ১৯৪২ সালে ‘ভারত-ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৩১-১৯৪৫ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করে মোট পাঁচবার কারাবরণ করার জন্য তাঁকে স্বাধীনতার পর ভারত সরকার তাম্রপত্রে সম্মানিত করে।
মহিলাদের মধ্যে দেশ স্বাধীন করার সংগ্রাম প্রসারিত করার জন্য ১৯৩০ সালে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৯ সালে সিলেটে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দলে দলে সিলেটের মহিলাদের সেই সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন নরেশনন্দিনী দত্ত, সরলাবালা দেবীরা। বিপ্লবী সুহাসিনী দাসকে ওই সভায় তাঁরা ডেকে নিয়ে আসেন। ওই সম্মেলনে সুহাসিনী প্রথম মহিলাদের চরকায় সুতো কাটতে দেখেন। ওই সম্মেলন ও চরকা কাটার দৃশ্য সুহাসিনীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের কর্মীরা শুধু সুতাই কাটতেন না পাশাপাশি পত্রিকা পড়তেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের খবর রাখার পাশাপাশি তাঁদের কাটা সুতো পাঠানো হতো ধীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত ‘বিদ্যাশ্রম’-এর দোকানে আর তার বদলে পেতেন থান কাপড়। সেই কাপড় দিয়ে নরেশনন্দিনী দত্ত ও অন্যরা মিলে পর্দা, চাদর প্রভৃতি তৈরি করতেন। পঁচিশ পয়সা চাঁদার বিনিময়ে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের সদস্যারা জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ লাভ করেছিলেন। জানা যায় যে, চা-বাগিচা শ্রমিকদের মধ্যেও মহিলা সংঘের সদস্যরা স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্ব ও স্বদেশী পণ্যের ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাতেন। নারী নেত্রী নরেশনন্দিনী দত্ত-কে বিপ্লবী সুহাসিনী দাস তিনি ‘কর্মজীবনের গুরু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
সিলেটবাসী হিসেবে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের স্বামী লোকেশ্বরানন্দ(কানাই মহারাজ)-এর সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের নেতৃস্থানীয় সদস্যরা এতটাই সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন যে তাঁদের এক বিশাল অংশ পুলিশের হাতে ধরা পড়তে শুরু করেন। ‘কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট ইন সিলেট অ্যাজ সিন বাই সুহাসিনী দাস’ নিবন্ধে উল্লেখ রয়েছে, ‘অন্যান্য ধৃতদের মধ্যে ছিলেন, সুনীতিবালা দেবী, প্রফুল্লকুমারী দত্ত, যামিনীবালা দাস, হিরণবালা দেবী, উষারাণী দাস, উমা চক্রবর্তী, লীলাবতী দত্ত, সুখদা পালচৌধুরী, শোভনা দেবী, নরেশনন্দিনী দত্ত ও চারুশীলা দেবী।’ ওই নিবন্ধে আরও জানা যায় যে, শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের নেত্রী সরলাবালা দেবী বেশ কিছুদিন পরে ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি গঠনমূলক কাজে সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের নেতৃত্ব। শ্রীহট্ট মহিলা সংঘরে একটা ‘শিল্প স্কুল’ ছিল। ওই স্কুলে তাঁতের কাজ, চরকায় সুতা কাটার কাজ, চামড়ার ব্যাগ, স্যান্ডেলের ফিতা তৈরি এসব কাজ করতেন শিল্পীরা। নরেশনন্দিনী দত্ত, সরলাবালা দেবীদের কাজ ছিল শিক্ষাযর্থী ধরে আনা।
সিলেট মহিলা সংঘ তখন কংগ্রেসের একটি শাখা সংগঠন হিসেবে নানা ধরনের কাজ করে শুধু জেলায় নয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের কর্মী নরেশনন্দিনী দত্ত বাসায় এসে সুহাসিনীকে বাইরে যাবার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। নরেশনন্দিনী বাড়ি বাড়ি গিয়ে রাজনৈতিক মতবাদ ও সদস্য সংগ্রহ করতেন। এভাবে ঘরে বসেই সুহাসিনীর মত অনেকেই নরেশনন্দিনীর কাছে রাজনৈতিক খবরাখবর পেতে শুরু করেন। সে অর্থে বিপ্লবী সুহাসিনী দাসের রাজনীতির প্রথমপাঠ সম্পন্ন হয় ঘরে বসেই নরেশনন্দিনীর কাছে।
১৯৩০ সালে ২৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের অনুসারী হয়ে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ’ স্বাধীনতা দিবসের শোভাযাত্রা বের করে। এ শোভাযাত্রায় পুলিশি বাধার মুখেও জোবেদা খাতুন চৌধুরানী স্বাধীনতার সংকল্প পাঠ করানোর মত দুঃসাহস দেখান।
এদিকে সিলেটে ১৯৩৪ সালের ২জুলাই বিপ্লবী অসিত ভট্টাচার্যের ফাঁসির ঘটনা এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। এটি ছিল সিলেটে প্রথম রাজনৈতিক ফাঁসির ঘটনা। সেই ঘটনা মহিলা সংঘের কর্মীদের মনে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছিল। তারপর সংগঠন আরও জোরদার করার ব্যাপারে সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কয়েক মাস পরে ১৯৩৫ সালে জওহরলাল নেহরু শিলং থেকে ডাউকি হয়ে সিলেটে শহরে গিয়েছিলেন। শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের নরেশনন্দিনী দত্ত, সরলাবালা দেবীদের সিদ্ধান্তে স্নেহলতা দেব ও সুহাসিনী দাস নেহরুকে অভ্যর্থনা জানান।
শ্রীহট্ট মহিলা সংঘের এতটাই সুখ্যাতি ছিল যে, ১৯৪৬ সালে নোয়াখালির দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণের ও পুর্নবাসনের কাজে সদস্যারা গান্ধিজির ডাকে দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে ছুঁটে গিয়েছিলেন। নোয়াখালিতে টানা চার বছর নরেশনন্দিনী দত্ত গান্ধিজির নির্দেশে সেই কাজে যুক্ত ছিলেন, ছিলেন সুহাসিনী দাসও। পরবর্তীকালে ভূদানযজ্ঞ ও অভয় আশ্রমের গঠনের কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। সিলেটবাসী হিসেবে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের স্বামী লোকেশ্বরানন্দ(কানাই মহারাজ)-এর সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ৮১ বছর বয়সে ৪ এপ্রিল, ১৯৮৩ উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরের বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।