শুনেছিলাম জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী না-কি এক হাতে রান্না করতেন আর অন্য হাতে কবিতা লিখতেন। সম্ভবত এই কথাটির মধ্যে রয়েছে বাঙালি রমণীর যাপিত জীবন ও সৃজনশীল চর্চার স্বরূপ। ‘রূপসী বাংলার কবি’ বাংলার যে-রূপ দেখেছিলেন, সেটা অপরূপ বা সৌন্দর্য ছিল না—তা ছিল স্বরূপ বা প্রকৃত চেহারা। আর তিনি জানতেন—সারা পৃথিবী হাজার বছর ধরে পরিভ্রমণ করলেও নারীর, পুরুষের—মানুষের অন্য কোনো চেহারা দেখতে পাওয়া যাবে না। তাই তিনি ‘পৃথিবীর মুখ’ খুঁজতে চাননি। রবিঠাকুরের ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের বর্ণনাকারী চরিত্র মৃণালের কথাও যদি ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে—বাঙালি রমণী তাদের কল্পনা প্রকাশের কোনো সুযোগ বা পরিবেশ পায়নি কখনও। মৃণালিনী যে কবিতা লিখতো, তা তার স্বামীও টের পায়নি। —এই ভয়াবহ, গোপন ও নীরব জীবন পার করতে হয় বাংলার মেয়েদের (নারীদের)। অবশ্য ছেলেদের (পুরুষের) প্রশংসা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল এই নারীকুল বারবার কবিতার শোভা বর্ধন করেছে। যদিও বাঙালি সুন্দরী বলতে সাধারণভাবে ফর্সা মেয়েদেরকেই বুঝায়, তবু কোনো এক কবি ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ বলে সত্যিকারভাবে বাঙালি পুরুষের মনের ও চোখের এক আধ-ভেজানো জানালা খুলে দিয়েছেন। সে-জানালা দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি জীবনানন্দের কল্পনার নক্ষত্রভরা আকাশ আর জসীম উদদীনের পরিকল্পনায় বিরাজ-করা নারী-পুরুষের সুখের সংসার—যেখানে ‘মাঝখানে সময়ের মনের মশারী তবু ব্যবধান রাখে’। —এই কবি ওমর আলী। শৈশব-কৈশোরের মাতৃস্নেহহীন এক নিঃসঙ্গতা তাঁকে কবি করে তুলেছে। হয়তো মনে মনে মাকে খুঁজতে খুঁজতে চারপাশে তিনি বাংলার যে ছবি দেখেছেন, তা প্রকাশ করেই ‘মা’ ডাকতে না পারার হাহাকারকে প্রকাশ করেছেন কবিতার শব্দে ও সুরে।
ওমর আলী শ্রেষ্ঠ কবিতা (ঢাকা, বইপত্র, ২০০২) গ্রন্থের ‘কবিতার কথা’ শিরোনামের ভূমিকায় লিখেছেন : ‘যখন হাঁটা শিখেছিলাম মাত্র তখন মাতৃবিয়োগ হয়েছিলো। সেই মাতৃস্নেহের বঞ্চনাই হয়তো আমাকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।’ দার্শনিক কবি ওমর আলী সারাজীবন এই যন্ত্রণাকে ধারণ করে নিজের ভেতরের কথোপকথনগুলোকে সাজিয়ে তুলেছেন কবিতায়। তাই তাঁর কবিতা হয়েছে প্রেমের—গভীর প্রেমের। কখনও বিবরণকে কখনও সংলাপময়তাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে তাঁর কবিতার ডাল ও পালা। ওমর আলী প্রেমকে নারীর পুরুষের অধিকার হিশেবে দেখেছেন; দেখেছেন প্রেমের নামে প্রবঞ্চনাও। ইজ্জত রক্ষার সংগ্রাম আর সম্মান হারানোর বেদনায় বাঙালি নারীর সামাজিক অবস্থান যে কতোটা বিপন্ন, তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। এ-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য দেখে নেওয়া যেতে পারে—
গ্রামে থেকেছি ও আছি বহু বছর ধরে, মানুষের সঙ্গে মিশেছি। তাদের সুখ-দুঃখের জীবন সম্পর্কে জেনেছি খুব কাছ থেকে, তাদের সঙ্গে চলাফেরা করে বাস করে ঝড় বৃষ্টি খরা বন্যায় গ্রামের দুরবস্থার মধ্যে তাদের সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনের সঙ্গী হয়ে। নারী-পুরুষের অপমৃত্যু দেখেছি। অসংখ্য যুবতী গৃহবধু ও কিশোরীর অকালমৃত্যু দেখেছি কঠোর সমাজের যৌতুক প্রথা ও পারিবারিক অশান্তির কারণে।… নারী ও কিশোরীর ইজ্জত লুণ্ঠন ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ক্ষেতে-খামারে, নদী পুকুরে ফেলে রাখার ঘটনা আমি শৈল্পিক প্রক্রিয়ায় বিধৃত করেছি মাত্র।’ (শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা-অংশ দ্রষ্টব্য)
ওমর আলীর কবিতা কীভাবে পাঠ করা যেতে পারে—নারীবাদী দৃষ্টিতে না-কি জাতীয়তাবাদের বিবেচনায়? বাঙালি যে রমণী সংসারের সকল কাজ করেও অধিকার আর মর্যাদার প্রশ্নে রয়ে গেছে একেবারেই নিচের স্তরে, তাদের জীবন ও যাতনা নিয়ে ওমর আলীর যে পর্যবেক্ষণ, তাকে কোন মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করা চলে? তিনি কিছুতেই সুয়োরানীদের গল্প লিখতে পারলেন না—তাঁকে লিখেতে হলো বাংলার দুয়োরানীদের দুর্দিনের কাহিনি। এদেশের রমণীদের একটাই সান্ত্বনা—প্রশংসা বা সুনাম। সেই সুনাম শুনেছেন কবি। আর তার প্রধান কারণ হলো বাঙালি নারী তখনও প্রতিবাদ করতে শেখেনি। তখন তারা ‘সুশ্রী মেয়ে’টি হয়েই থাকতে চেয়েছে। আর তখনও রূপসীরা এখানে ‘ভাতের থালা সাজায়’। তখন বাংলার পুরুষেরা স্বপ্নে যে-নারীর ছবি এঁকে দিন গুনতো, তারা যৌবনের এক নিবিড় প্রার্থনায় নত থাকতো। সে-প্রার্থনায় ছিল নারীর রূপ নয়—শরীর। এক স্বপ্নাচ্ছন্ন পুরুষ-কথকের ভাষ্যে তুলে ধরা যেতে পারে কবির বর্ণনা—
… ওদের দেহের হাওয়া শুঁকে;
রাত হলে কিছুক্ষণ অতল আঁধারে ডুবে খেলা করি
স্তন নিয়ে আযৌবনা সুন্দরীর বুকে।
(‘যৌবনে প্রার্থনা এই’ : এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি)
ওমর আলীর ভাষা—শব্দ-নির্বাচন ও প্রক্ষেপণের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে বাংলার চরিত্র। কবিতার শিরোনাম নির্ধারণে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে এমনসব শব্দ, যা সরলভাবে কেবল সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়তাকে নির্দেশ করে। যেমন : ‘প্রাণের আগুনে’, ‘বেদনার মন’, ‘নিঃশব্দ’, ‘ঝরের রাত্রিতে নৌকায়’, ‘আমি কিন্তু যামুগা’, ‘এখন পালাও দেখি’, ‘পাথর’, ‘বৃষ্টির বিপদে এক চড়ুই’, ‘তুমি যদি মরে যাও’, ‘দূরের গান’, ‘ক্ষমা করে দিলাম’, ‘শব্দের জন্ম নিয়ন্ত্রণ’, ‘বনলতা সেন যায় আদালতে’, ‘ভয়ানক নীচে পড়ে যাচ্ছি আজ চুয়ান্ন বছর’, ‘কল্পনা নেবেন?’, ‘সাহস ছিল’, ‘পথে পড়ে থাকা একটি বোতাম’, ‘গৃহবধু বিপুলী বেগমের বস্তাবন্দী লাশ’, ‘নিশ্চিন্তপুর যাবো’, ‘পাটখেতে রূপসী যুবতী গৃহবধু’, ‘একটি লোক শূন্য নদী তীরে’, ‘কালো লোহা লাল লোহা’, ‘সান্ত্বনার সাথে দেখা’, ‘স্বপ্নের অন্ধকার রাতে’, ‘স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন’, ‘নাটকের বিমর্ষ প্রেমিক’, ‘মৃত্যু মাখা স্বদেশ’। যে-শ্যামলা মেয়েদের প্রশংসা শুনে শুনে বড় হয়েছেন কবি ওমর আলী, সেই বনলতার মতো রহস্যঘেরা সুন্দরীদের জন্য এই সমাজের লোকেরা কখনও সহৃদয় ছিল না—পুরুষেরা জুয়া-গাঁজা-হেরোইনে আচ্ছন্ন হয়ে নারীকে ব্যবহার করেছে টাকার উৎস হিশেবে; যৌতুকপ্রথার কঠিন ছোবলে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল ওমর আলীর সময়ের বাংলার সমাজ ও রাষ্ট্র। এমন ভঙুর সমাজে, নিম্নগামী সমাজে হাহাকার করা ছাড়া একজন কবির পক্ষে কী-ইবা করার থাকে? ওমরের কণ্ঠে তাই শোনা যায় তীব্র চিৎকার—
হিংস্র নখ তৈরি হয়ে আছে
কিংবা গভীর সেই অতল অন্ধকার তরলে ডুবে যাবো
আর আমি ওপরে উঠতে পারবো না—আমি পড়ে যাচ্ছি নীচে
পড়ে যাচ্ছি নীচে শুধু নীচে গভীর নীচে আকাশের মতো উঁচু থেকে
উচ্চাভিলাষের মোমের পাখা গলে গিয়ে…
(‘ভয়ানক নীচে পড়ে যাচ্ছি আজ চুয়ান্ন বছর’: তোমাকে দেখলেই)
বাঙালি কি উচ্চাভিলাষী জাতি? হতে পারে। অন্তত মাইকেল মধুসূদনের জীবনী পাঠ করলে তো তেমনটাই মনে হয়। আধুনিক বাংলা কবিতার এই মহান পুরুষের ওপর ভরসা করেছিলেন উত্তরপ্রজন্মের এক কবি (আবিদ আজাদ); মধ্যবয়সে বাংলা কবিতার মাথায় উকুন দেখতে পেয়ে কল্পনা করেছিলেন—মধুকবি চিরুনি হাতে সেই মাথায় চালাচ্ছেন নিবিড় অভিযান। এদিকে অন্য এক আধুনিক কবি ওমরকে দেখা যায় ঐতিহ্যের ডানায় ভর করে পরিবর্তনের কল্পনা করতে। গ্রিক মিথের আশ্রয় নিয়ে তিনি বাঙালির উচ্চাভিলাষকে শিল্পের আলোয় দেখতে চেষ্টা করেছেন। স্বপ্নবাজ এই দার্শনিক কবি লিখেছেন সে-কথা—
তার রাগী ধারণা যে রাজা হবে তার সিংহাসন থাকবে না মুকুটও থাকবে না…
দুঃখের নীচে চাপা পড়ে আছে
তাকে কাঁপিয়ে কোথা থেকে জনশূন্য ট্রেন আসে চলে যায়
কারো নজরে পড়ে না…
আনন্দ নামে কোনো লোকালয় গড়ে উঠলে সে
সেখানে স্থায়ী বসত করবে…
সে চীৎকার করে ফেরিঅলা পশারীর মতো কল্পনা নেবেন? ভাল কল্পনা
কিন্তু তার এই চিৎকার মানুষের কানে পৌঁছায় না…
(‘কল্পনা নেবেন?’ : আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে)
হ্যাঁ, ভেতরে ভেতরে হয়তো সত্যি দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিলেন কবি ওমর আলী। কিন্তু তার পেছনে বিস্তর পড়ে আছে কাছারি বাড়ি, ঘুড়িওড়ার বিকেলবেলা, পিতামহ, খাজনার রশিদ, কার্বন কাগজ কিংবা পথের ধারে কুড়িয়ে-পাওয়া একটি বোতাম; কিংবা একাত্তরের কোনো নির্জন সন্ধ্যায় গোপাল লাহিড়ী স্যারের বলা কথাগুলো। পেছনে পড়ে গেছে স্বপ্ন কিংবা উচ্চাশা। কেননা, তাকে আঁকড়ে ধরেছে তখন কোনো না-বুঝা বিভ্রম। মফস্বলের কবিকে এমনিতেই অতিক্রম করতে হয় অনেক প্রতিবন্ধকতা। তার ওপর যদি থাকে নিজস্ব দ্বিধা? তখন? পথে পড়ে থাকা একটি বোতাম কুড়াতে-যাওয়া যুবক কবি জানাচ্ছেন তার সেই প্রাতিস্বিক দ্বিধাতরঙ্গের কাহিনি—
আমি আজকাল পথে পড়ে থাকা একটি বোতামের দিকে তাকিয়ে
পাবনা শহর কিংবা চর করমপুরের দিকে কিছুদূর যাবার পরেই
মনে করি কেন কুড়িয়ে নিলাম না
নাকি ফিরে গিয়ে কুড়িয়ে আনবো
আমি এ রকম দ্বিধাগ্রস্ত
(‘পথে পড়ে থাকা একটি বোতাম’ : যে তুমি আড়ালে)
ওমর আলী কোন ভাষায় কথা বলেছেন—সেটি জানা খুব জরুরি মনে হয়। নিজের ভাষায় লিখেছেন কবিতা? না-কি লোকালয়ের ভাষা, জনতার হৃদয়ের অনুভবকে তাদের না-বলা ভাষায় প্রকাশ করেছেন? সমগ্র নিজস্ব-কাব্যসভায় কবি ওমর আলীকে স্থাপন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যাবে, তার চিরদিনের গ্রাম, তার স্বজন-পরিজনের চেনা পথ-ঘাটে যে গল্পগুলো মার খেয়েছে সময় ও সমাজের হাতে, সেগুলোকে তিনি ভাষা দিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার ‘মফস্বলি চিন্তা’—নগরীয় প্রান্তরে কতটুকু ঠাঁই পেল—সে বিবেচনা করার সময় হয়েছে। কেননা, ফেমিনিজম এগিয়েছে অনেকটা, নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে পিছিয়েপড়া দেশগুলো বেশ সোচ্চার ও অনেকটা কার্যকরও বটে; ওদিকে চেতনা-বাজারে আধুনিকতাকে পেরিয়ে যাচ্ছে উত্তরাধুনিকতার চাতাল, সোশ্যালিজম ও ন্যারাচালিজম আজও কোথাও কোথাও প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে; আবার এক দিকে খাবি খাচ্ছে গণতন্ত্র; বারবার ঘুরে-ফিরে হানা দিচ্ছে রাজতন্ত্র—এতোসবের আড়ালে কবি ওমর আলীর দেখা বাংলাদেশের ‘সুনাম-শোনা’ রমণীরা কেমন আছেন, তা জানতে পারলে মন্দ হয় না। সে-তদন্তে পা বাড়িয়ে লাভ কি লোকসান, তার হিসেব পরে করে নেওয়া যাবে। তার আগে, প্রসঙ্গত, একবার পরখ করা যেতে পারে ওমরের কালো-লাল সান্ত্বনাগুলো। ওমর যে বললেন—‘আসলে নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী আমি’। কেন বললেন? এই কথা বলে কি সমাজের জন্য কিছু-করতে-না-পারা এক কবি সস্তায় সান্ত্বনা খুঁজেছেন মাত্র? তাঁর ভাষায় পড়ে নেওয়া যেতে পারে খানিকটা—
সান্ত্বনার সাথে দেখা বহুদিন পরে
বললাম আমি ধীর স্বরে;
‘আমার হৃদয় নেই আগের হৃদয়,
চেয়ে দ্যাখো অগ্নিদগ্ধ, সমস্ত শরীর ভরা ক্ষয়।’
(‘সান্ত্বনার সাথে দেখা’ : প্রস্তরযুগ তাম্রযুগ)
প্রচলিত ভাবনার ভেতর দিয়ে পাঠ করলে ওমর আলীর কবিতায় সময়কে বদলে যেতে দেখা যাবে। কিন্তু নিবিড়ভাবে চিন্তা করলে ধরা পড়বে সত্য ঘটনা—সময় তো বদল করছে তার সময় কিন্তু সকলের দৃষ্টিকে ধোঁকা দিয়ে পাল্টাচ্ছে মানুষ ও সমাজ। এবং তিনি তাঁর যাপিত জীবনে চারপাশের মানুষকে, শৈশব থেকে যৌবনে পাড়ি দেওয়ার পথে কিংবা সাফাই ও সাফল্যের গানের প্রহরে আড়ালে পরিণত বয়সেও মানুষকে তার রুচি ও কল্পনা পরিবর্তন করতে দেখেছেন। দর্শন-জিজ্ঞাসাও বোধকরি এমনই। কারণ মানুষ বদলায় তার বিশ্বস ও ভাবনা নিয়েও। ওমর আলীর মতো অবৈষয়িক-‘অসফল’ ব্যক্তিদেরকে তখন চুপসে যেতে হয় স্বাভাবিকভাবেই। কবি অনুভব করেছেন—সময় বদলের সাথে সাথে যেন হারিয়ে যাচ্ছে আশা ও ভরসার সম্ভাব্য আশ্রয়গুলো; সভ্যতার নাম ভাঙিয়ে সভ্য নাগরিকেরা গিলে ফেলছে প্রকৃতি-স্বভাব নির্মলতা। এগুলো কোনো নতুন ব্যাপার নয়—ঘটছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো চারপাশের লোকেরা সেগুলো দিব্বি মেনেও নিচ্ছে। কবি ওমরের না-মানা মনের দোলাচলতা যেন মৃদু আলোড়ন তোলে তাঁর কাব্য-ভাবনায়। তিনি হয়তো মানুষের এবং সর্বোপরি সমাজের এমন অবস্থান ও অবস্থাকে ‘স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন’ ভেবে থাকবেন। এখানে তাঁর কবিতা থেকে একটুখানি পড়ে নেওয়া যেতে পারে—
এত দ্রুত শৈশব হারালে
ঘরে লোক আছে কিন্তু নেই
সবাই ভেতরে অথচ বাইরে—
এ রকম হলে কাকে ডেকে পাবো
অন্ধকার হলে কার সাথে আর কথা বলা যাবে
ভিন্ন লোকালয়ে যেতে কে তখন পথ বলে দেবে
চরম দুর্ভিক্ষ ক্ষুধার্ত স্বভাব মানুষের পথে অরণ্যের
ঘাস পেতে দিয়ে বৃক্ষের সবুজ পতাকা তুলে দিয়ে
আরো বেশী অরণ্য সৃষ্টির প্রবণতা
প্রত্যেকেই শহরের অপরিচয়ের গভীরে চলে গেলে
কাকে জিজ্ঞাসা করবো ভালোমন্দ কথা
(‘স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন’ : স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন)
এই অমানিশা থেকে নিজেকে আড়াল করতে ‘নাটকের প্রেমিক সেজে’ জীবনের, সময়ের, সমাজের সকল বিয়োগান্ত ঘটনাগুলোর বিমর্ষ বিবরণ তুলে ধরেছেন কবি ওমর আলী। চারপাশে ঘটতে-থাকা ব্যাপারগুলো তিনি ‘পৃথিবীতে আসার আনন্দে’ মেখে রাখতে পারেননি। ভুলতেও পারেননি। ‘একটা দোলনার সাথে একমুঠো আশা’ দোলাতে গিয়ে তিনি মনে ও মননে স্বদেশকে ধারণ করেছেন। লোহায় গড়া সমাজকে আগুনে পুড়িয়ে নতুন কাঠামো দেওয়ার কল্পনা ও পরিকল্পনাগুলো তিনি বাস্তবে রূপ পেতে দেখেননি। তারপর তিনি হয়তো মানুষের নয়—‘সামাজিকের’ আশা ছেড়ে ‘পাখিদের টেলিফোন’ প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু কীভাবে যেন তাঁর ‘মস্তিষ্কে হঠাৎ জ্যোৎস্নাহীন কালো প্রহরে বিস্ফোরন ঘটে গেল’। অতঃপর তিনি কোনো শ্যামল রঙ রমণীর কথা মনে করে ‘তোমার মুখের মতো মুখ এই পৃথিবীর কোনো/ প্রান্তরে দেখেছিলাম রৌদ্রের ভেতরে সুস্মিত,/ আরক্ত গোলাপ’ বলতে বলতে দিনশেষে মানুষ নয়—কবি হয়েই বেঁচে রইলেন।
১ Comment
পড়লাম ফজলুল হক সৈকত এর “ ওমর আলীর উচ্চাভিলাষ কিংবা দ্বিধা ” নামের নিবন্ধটি । সুলিখিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে জীবনানন্দ দাশ-আল মাহমুদ- আবুল হাসান এই তিনজন কবিতা বেশি পছন্দ করি। ওমর আলীর কবিতা পড়েছি। মোটামুটি ভালো লেগেছে কিন্তু উল্লিখিত তিনজনের কবিতার মতো অতটো ভালো লাগেনি। তবে এই নিবন্ধে উদ্ধৃত কবিতাংশগুলো বেশ ভলো লাগলো। ফজলুল হক সৈকত খুকসুন্দরভাবেউপস্থাপন করেছেন ওমর আলীকে, তাঁর কবিতাকেও।