আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির এ্যারোনটিকস এর প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমার সাথে পড়ত আরো দু’জন এশিয়ান─সুমিত্রা পাঠক আর হো ই সুসান। সুসান জাপানী হলেও চালচলনে ছিল পুরোপুরি ইউরোপীয়। তার সাথে আমার সম্পর্কটা তাই বন্ধুত্ব পর্যন্ত গড়ায়নি। সুমিত্রার বাড়ি ভারতের কোচিনে। বাবা লোকসভা সদস্য; প্রচুর বিষয় সম্পত্তির মালিক। মাত্র ক’দিনেই সুমিত্রা আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে।
মধ্য ডিসেম্বরের কথা। অনেক শীত পড়েছে। তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি । প্রাকটিক্যাল ক্লাশ শেষে হলে ফেরার জন্যে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর সুমিত্রা। পাশে এসে দাঁড়াল আমাদেরই ক্লাসের এক মেয়ে─মার্সি। গায়ে ধুসর রংয়ের ওভারকোট, মাথায় হালকা নীল রঙের একটা হ্যাট; গভীর প্রশান্ত চোখজোড়ায় দৃষ্টি ধরে রাখা যায় না। সব মিলিয়ে চেহারায় কী একটা অদ্ভুত আভিজাত্য আছে তার। সুমি বলল
─মার্সির সাথে তোমার আলাপ আছে?
মার্সিকে আমি চিনি হিউস্টনে আসার ক’দিন পর থেকেই। যেদিন আমাদের প্রথম ক্লাস শুরু হবে সেদিন সে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে একা একা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। কোন ব্যস্ততা নেই, কোন উদ্বেগ নেই। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তার সাথে কথা বলি। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। গত এক মাস ধরে আমি তাকে লক্ষ করে আসছি। সে ঐ প্রথম দিনের মতই রয়ে গেছে।
─মার্সির দিকে তাকিয়ে আমার পরিচয় দিলাম
─আমি মামুন, বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
সুমিত্রা সঙ্গে যোগ করে দিল
─ও একজন ভাল কলামিস্ট, দেশের পত্র-পত্রিকায় ওর প্রচুর লেখা ছাপা হয়।
মার্সি হাত বাড়িয়ে দিল না। ‘তোমার সাথে দেখা হওয়ায় খুশি হলাম’─ধরনেরও কিছু বলল না। শুধু একটু হেসে বলল
─তাই?
আলাপের বিষয়বস্তু খুঁজে না পেয়ে বললাম
─খুব শীত পড়েছে।
আমার দিকে না তাকিয়েই মার্সি বলল
─আবহাওয়া দপ্তর বলছে তাপমাত্রা আরো কমে যাবে।
বাস এসে গেল। আমরা তিনজন একটাতে উঠে পড়লাম। তারপর বহুবার মার্সির সাথে আমার দেখা হয়েছে; সেই স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যস্পৃষ্ট হাসি, কখনো- সখনো অসাধারণ পরিমিতিবোধতাড়িত ছোট্ট জিজ্ঞাসা
─‘কেমন আছ?’
আমি বলতাম
─‘ভাল’।
ব্যস শেষ। মাস চারেক পরের ঘটনা। ইউতা স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক এইচ জি কলিন্সের একটা দুষ্প্রাপ্য বইয়ের তৃতীয় সংস্করণ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। বইটা কিনতে হবে। বিকেলের দিকে উইলসন মেমোরিয়াল পার্ক রোড ধরে হাঁটছিলাম। গন্তব্য হার্টসভিল এভিন্যূ। বেশ কিছু বইয়ের দোকান আছে রাস্তাটার দু’পাশে।
─মানুম।
পেছন থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকছে। ফিরে তাকালাম। মার্সি। কাঁধে একটা কলাপাতা রঙের প্যালিকান ব্যাগ। আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বললাম
─আমার নাম মানুম নয়, মামুন।
মনে হয় একটু লজ্জা পেল সে। বিনয়ের হাসি হেসে ক্ষমা প্রার্থনা করল
─নিজের নামটা মানুষের খুব প্রিয় জিনিস। আমি দুঃখিত। তুমি কোথায় যাচ্ছ?
─হার্টসভিল এভিন্যূতে, বই কিনতে।
─আমি কি তোমার সাথে যেতে পারি?
আমি খুশি হয়ে গেলাম
─অবশ্যই, কেন নয়!
আমার বই কেনা হয়ে গেলে মার্সি দুটো বই কিনল─‘হিস্ট্রি অব স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রিজ’ এবং ‘রোম─এ সিটি অব থ্রি থাউজেন্ড ইয়ারস’।
জিজ্ঞেস করলাম
─এগুলো তোমার কী কাজে লাগবে?
─অবসরে পড়ব।
─তুমি তো মম অথবা ডিকেন্সের উপন্যাস পড়েও সময় কাটাতে পার।
─সাহিত্য আমার ভাল লাগে না।
─সত্যিই তাই?
আমার প্রশ্নের সে কোন উত্তর দিল না। মৃদু হেসে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
─আজ পার্কে ফরাসী একটা বিখ্যাত সঙ্গীত দলের অনুষ্ঠান আছে।
আমি বললাম
─জানি। যাবে?
সে রাজী হয়ে গেল। আমরা পার্ক স্ট্রীট ধরে যখন হাঁটতে শুরু করলাম তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। রাস্তার সবগুলো নিয়ন বাতি জ্বলে উঠেছে। বিজ্ঞাপন বোর্ডগুলোর রং বেরঙের আলোর ঝলকানিতে হিউস্টন নগরীকে মনে হচ্ছে গ্রহান্তরের কোন অচেনা জনপদ। মার্সি নীরবতা ভাঙল
─তোমার দেশে ‘ডিনাজপুর’ নামে কোন শহর আছে?
প্রশ্ন শুনে চমকে গেলাম। বললাম
─হ্যাঁ, আছে। দিনাজপুর। তুমি জান কী করে?
আমার জিজ্ঞাসার জবাব মিলল না।
সে জিজ্ঞেস করল
─কেমন শহরটা?
আমি কখনও দিনাজপুর যাইনি। তবে আমি খুব ভাল করেই জানতাম হিউস্টনের স্যাকসনভিলের চেয়ে কোন অংশেই উন্নত নয় আমাদের জেলা শহরগুলো। স্যাকসনভিলে বাস করে মুলত নিম্নবিত্ত আফ্রো-এশিয়ান অভিবাসীরা।
তবু বললাম
─দিনাজপুর। বেশ ভাল শহর; নিরিবিলি।
ভেবেছিলাম এবার সে কিছু একটা বলবে। কিন্তু বলল না। আমরা পার্কে এসে গেলাম। পাশাপাশি চেয়ারে বসে আমি আর মার্সি অনুষ্ঠান দেখছি। যুগল কণ্ঠে গান গাইছে দুটো ছেলে :
মার্সি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল
─ওরা কি বলছে জান?
─না তো!
─বলছে, ফ্রান্সের ধূসর গোলাপের জন্যেই বিধাতা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।
শুনে আমার খুব ভাল লাগল। বললাম
─সাংঘাতিক কাব্যি আছে কথাটায়। তাই না?
─হ্যাঁ, তা হয়তো আছে। কিন্তু এতটা কল্পনাবিলাসী হবার যুক্তি আছে কি?
─দেখ, কেউ যখন তার দেশের প্রশংসা করে তখন কিছুটা অতিরঞ্জন এসেই যায়। ধনী- দরিদ্র নির্বিশেষে পৃথিবীর সব দেশের জনগণের ক্ষেত্রেই কথাটা সমানভাবে ব্যবহার করা চলে।
মার্সি শুধু বলল
─অবাস্তব।
পুরো অনুষ্ঠানে গাওয়া সবগুলো গানের মুলকথা মার্সি আমাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। কিছুটা অবাক হয়ে মার্সিকে জিজ্ঞেস করলাম
─এ দেশে তো ফরাসি ভাষা কেউ চর্চা করে না। তুমি এত ভালো ফরাসি জান কী করে?
মার্সি মৃদু হাসল। অনুষ্ঠান শেষে একটা মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে আমরা হলে ফিরলাম। এরপর ধীরে ধীরে মার্সি আমার সাথে সময় কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকে একটা পাহাড়ের মাথায় আমরা বিকেলের দিকে মাঝে মধ্যেই বসতাম; বিশেষ করে উইক এন্ড- এ। পাহাড়টায় গাছপালা নেই। পাথুরে। সে কারণেই হয়তো নাম ব্যারেন হিল।
মার্সি একদিন হঠাৎ বলল
─মামুন, তোমার বাবা মা- র কথা মনে হয় না?
আমি বললাম
─তাদের কাছে আমি মাসে দুটো করে চিঠি লিখি। কই, তুমি তো তোমার বাবা মা- র কথা কোনদিন বললে না!
মার্সি চুপ করে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল
─জান মামুন, আমাদের পৃথিবীটা সূর্যের চারদিকে প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে আঠার মাইল বেগে ছুটে যাচ্ছে। আমরা যখন বসে কথা বলছি তখনও কিন্তু আমরা আসলে একটা ছুটন্ত মহাকাশযানের পিঠে বসে আছি। কতশত কোটি বছরের এ পৃথিবীটা তার মায়ার বাঁধনে কাউকে ধরে রাখতে পারেনি। আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ঈর্ষা, ক্ষোভ কোন কিছুই আমাদের মৃত্যুর পর টিকে থাকবে না। খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে কোন লাভ নেই। সব কিছুই এত বেশি ক্ষণস্থায়ী যে, এক অর্থে এসব পুরোপুরি অর্থহীন।
মার্সি আবারও অনেকটা সময় চুপ করে রইল। বলল
─আস না আমরা একটু হাত ধরে হাঁটি ।
আমি ঠাট্টা করলাম
─এটা শিশুদের কাজ।
─তা ঠিক, তবে আমাদের সবার উচিত শিশুদের মত সব কিছুতেই আনন্দের উপকরণ খুঁজে পাবার যোগ্যতা অর্জন করা। যখন তুমি খুব ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ পাবে তখন দেখবে পৃথিবীটা কত সুখময় হয়ে ওঠে।
মার্সি লিখেছে, ওর বাবা ফাদার স্যান্ডোজ বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরের কোন এক গির্জার ভিকার। তাকে খুঁজে বের করে জানাতে হবে, মার্সি তার সাথে দেখা করার জন্যে তেইশ ডিসেম্বর এদেশে আসবে।
এভাবে মার্সি আমার প্রবাস জীবনের নিঃসঙ্গতাকে কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙিয়ে তুলল। পৌষের ধুলোট প্রান্তরে হলুদ সর্ষে ফুলের সমারোহের মত সর্বব্যাপ্ত প্রশান্তিতে সে ছেয়ে ফেলল আমার অস্তিত্বের সমগ্রতাকে। এরই মধ্যে আমার আবাস জর্জ ওয়াশিংটন হোস্টেলের একশ একত্রিশ নম্বর কক্ষের জানালায় তিন তিনটি বসন্ত এসে হানা দিয়ে গেল। কোর্সের শেষ পরীক্ষা হতে আর চার মাস বাকি। তারপরই দেশে ফেরার পালা। এপ্রিলের মাঝামাঝি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে লেনন অবজারভেটরি টাওয়ারে একটা প্রাকটিক্যাল ক্লাসের সিডিউল ছিল। হিউস্টন বিমানবন্দরে অবতরণ এবং বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নকালে বিমানের গতি মাপার জন্যে খুব সুবিধাজনক জায়গা এটি।
ডিপার্টমেন্টের বাসে করে লেনন যাচ্ছি। মার্সি আমার পাশে বসেছে। ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। রাস্তার পাশে অসংখ্য টিলা আর কাঁটা গুল্মের ঝোপ। গাছ-গাছালিতে নতুন পাতা এসেছে। অযত্ন লালিত উইন্টার একোনাইট, উইচ হেজেল, ক্রোকাস, স্নো ড্রপ অযুত পাপড়ি মেলে বসন্তের আবাহনী গাইছে। গোটা শীতকাল প্রকৃতির রুক্ষতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকবার কী এক দুরন্ত প্রেরণা ধারণ করে ছিল ঐ গাছগুলো তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বাস চলছে ঘন্টায় একশ’ বিশ কিলোমিটার বেগে। মার্সি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ক্যাসেট প্লেয়ারে এ্যানি সিমসনের গান বাজছে─‘ডোন্ট ক্রাই সীগাল’…। মার্সি ব্যাগ খুলে ল্যাম্ব বার্গারের দুটো প্যাকেট বের করলো। একটা আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘খাও’। এদেশে আসার পর হাতে গোনা যে কটা খাবার আমার পছন্দ হয়েছে ল্যাম্ব বার্গার তার একটি। মার্সি সেটি ভাল করে জানে। আমি খেতে শুরু করলাম। বললাম
─মার্সি আর ক’মাসের মধ্যেই আমি দেশে চলে যাব। আমি চলে যাবার আগে তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?
─তুমি কী শুনতে চাচ্ছ?
─আমি নির্দিষ্ট কিছু শুনতে চাচ্ছি না।
আর কথা এগোয় না। এক সময় আমরা লেননে এসে পড়ি। পরদিন দুপুর দুটো পর্যন্ত প্রাকটিক্যাল ক্লাশ হলো। আমার ইচ্ছে ছিল লেননের বিখ্যাত যাদুঘরটি ঘুরে দেখা। পূর্বে যে জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বাস করত তাদের অনেক দুর্লভ প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন এ যাদুঘরে আছে বলে শুনেছি। পেলিও- আমেরিকান শিকারিরা খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার অব্দে তেম্পিকো থেকে উত্তরে গালভিস্টন পর্যন্ত উপসাগরের পাশ ঘেঁষে যে গুহা সভ্যতা গড়ে তুলেছিল সে বিষয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে আমি একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। এ বিষয়ে আমার কৌতুহল বেশ পুরনো। মার্সিকে আমার ইচ্ছের কথা জানালাম। সে বললো,
“অন্য একদিন যাবো। আজ চলো সমুদ্র দেখে আসি”।
বিকেলে আমি আর মার্সি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সমুদ্রের পাড়ে। একটা বড় পাথরের ওপর দু’জন পাশাপাশি বসলাম। গঠনটা প্রায় বে অব বেঙ্গলের মত হলেও মেক্সিকো উপসাগরে কেন প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাস হয় না সে নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল মার্সি। আমি মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছিলাম একটি অমীমাংসিত বিষয়ের সমাধান পেতে। একসময় বললাম
─মার্সি আমি যদি এদেশে থেকে যাই, তাহলে তোমার কেমন লাগবে?
মার্সি বলল
─এখানে তোমার কেমন লাগে?
─সব মিলিয়ে ভাল।
─তাহলে থেকে যাও।
─তুমি থাকতে বললে থাকব।
মার্সি কিছুই বলল না। শুধু নাম না জানা এক গুল্মের পাতা ছিঁড়ে পাথরের ওপর আঙুল দিয়ে পিষতে লাগল। চার বছর হতে চলল মার্সির সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। প্রথম সেমিস্টারে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মেইনটেনেন্স এর ওপর আমাদের বেশ কঠিন একটা কোর্স ছিল। মার্সিকে আমি কোর্সটা পড়িয়েছিলাম। প্রথা অনুযায়ী আমাকে কিছু পারিশ্রমিক দিতে গেলে আমি তা নিতে অস্বীকার করি। ভারত উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে লালিত যে কেউ-ই এটা করতো। কিন্তু মার্সির কাছে বিষয়টা ছিল বিশেষ বদান্যতা। সে বার বার বলছিল
─তোমরা ভারতীয়রা এত মানবিক কেন?
সেই থেকে মার্সির সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা─বন্ধুত্ব। এই প্রথম তাকে আমি ভাল করে দেখলাম। লম্বা সোনালি চুলের অরণ্যে মুখের ডান দিকটা ঢেকে গেছে। ধবধবে ফর্সা মুখাবয়বটা ঢলে পড়া সূর্যের স্বর্নাভ আলোয় কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছে। দীর্ঘ বাঁকানো পাপড়ির আড়ালে এক জোড়া নিষ্পাপ সমর্পিত চোখ মুহূর্তে আমাকে কোন এক প্রার্থিত বিশ্বাসের কাছে নিয়ে গেল। বললাম
─আচ্ছা মার্সি, এমন কি কেউ আছে যাকে তোমার বিশেষভাবে ভাল লাগে?
সে সংক্ষেপে উত্তর দিল
─না।
এরকম একটা উত্তর শোনার জন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বললাম
─আচ্ছা, এমন যদি কেউ থাকে যে তোমাকে খুব পছন্দ করে?
মার্সি নিরুত্তর। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম
─তোমাকে আমার ভাল লাগে মার্সি।
মেক্সিকো উপসাগরের আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি তখন নিভস্ত সূর্যের রক্তবর্ণ আলোয় কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে বিরস পাথুরে উপকূলে। মার্সি চোখ তুলে সমুদ্রের দিকে তাকাল
─আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারনা মামুন?
জীবন থেকে সাতাশটি বসন্ত ঝরে গেছে; নিজের সম্পর্কে আমার জানা হয়নি কিছুই। মার্সি নামের আটপৌরে বন্ধুটির জন্যে নিজের মধ্যে এতটা ভাল লাগা, এমন অন্তহীন আকুলতা যে সঞ্চিত হয়েছে তা আমি নিজেই বুঝিনি। ওর ডান হাতটা দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম
─কেন তুমি ক্ষমা চাইছ মার্সি?
এই প্রথম আমি তার চোখে জল দেখলাম। শিশুর মত দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল সে। তাকে কিছুতেই থামাতে পারছিলাম না। আমাদের বাম হাতের দিক থেকে ততক্ষণে সোনার ডিমের মত পাণ্ডুর চাঁদটা উঠে এসেছে। প্রতিবিম্বটা তার বার বার ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে সাগরের জলে। আলোর একটা রেখা স্তম্ভের মত স্থির হতে যেয়েও জলের তোড়ে নড়ে উঠছে বারবার। বিবর্ণ চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা নির্জন সমুদ্র সৈকতের মতই স্থবিরতায় আবিষ্ট হলাম আমরা দু’জন। দীর্ঘক্ষণ আর কোন কথা হলো না। মার্সি এক সময় উঠে পড়ল। আমার কোমরে হাত রেখে ধীর পায়ে হেঁটে এলো ক্যাম্পে। পরদিন ভোরবেলা সুমিত্রা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল
─মার্সি চলে গেছে।
─কিছু বলে গেছে?
─আমার সাথে দেখা করে যায়নি।
সপ্তাহের শেষ দিন আমরা হিউস্টনে ফিরে এলাম। দু’দিন পর ডিপার্টমেন্টের সেমিনার লাইব্রেরিতে মার্সির সাথে আমার দেখা হলো । এক কোণার চেয়ারে বসে মোটা একটা বই থেকে কি যেন লিখে নিচ্ছিল সে।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম
─মার্সি, একটু বাইরে আসবে?
─কিছু বলবে?
─হ্যাঁ, জরুরি কিছু আলাপ ছিল।
─এখানেই বল।
─না থাক, অন্যদিন বলব।
আমি বেরিয়ে এলাম। লাইব্রেরির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সার্কুলার রুটের বাসে চেপে কোথাও যাব। কোথায় তা তখনও স্থির করিনি।
─মামুন।
ডাক শুনে ফিরে তাকালাম। মাথা নিচু করে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে মার্সি।
বললাম
─কিছু বলতে এসেছ?
─মামুন, আমি জানি তুমি শুদ্ধ মনের একজন মানুষ। তুমি তোমার মত ভাল থাকতে চেষ্টা কর। তোমার নিষ্পাপ অনুভূতিগুলোকে আমি কেন বারবার প্রত্যাখান করছি তা তোমাকে জানাতে চাই না ।
তারপর মার্সির সাথে আমার আর সময় কাটানো হয়ে উঠেনি। শেষ সেমিস্টারে আমি ডিস্টিংশন মার্কস পেয়েছি সে খবরটি জানাতে মার্সি আমার হোস্টেলে এসেছিল। কেপ কেনাভেরাল উৎক্ষেপণ মঞ্চ থেকে এপোলো ১১-র চন্দ্র অভিযান শুরুর ঐতিহাসিক মুহূর্তটিতে মার্সির সাথে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেটিই তার সাথে আমার শেষ দেখা। সেপ্টেম্বর এর দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার দেশে ফেরার দিনটি ভীষণ বিমর্ষ কাটলো। মনে হলো এক বিষম অসম্পূর্ণতা নিয়ে আমি অসময়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। প্রবাসও যে মানুষের আপন হয়ে উঠতে পারে সেটা আগে বুঝতাম না। আমার হোস্টেলের পেছন দিয়ে যে রাস্তাটা সেন্ট্রাল জিমনেসিয়ামের দিকে চলে গেছে তার পাশে একটা বড় ওক গাছ ছিল। প্রত্যেক হেমন্তে তার পাতা ঝরা এবং বসন্তে নতুন কিশলয় জেগে ওঠার দৃশ্য আমি আমার জানালায় বসে অনেক সময় নিয়ে দেখতাম। আমার মনে হতো এ ঘটনাগুলো শুধু আমার জন্য ঘটছে। জরা ও জীবনের এই অভূতপূর্ব দ্বৈরথের দর্শক আমি একা। এখন গাছটার নিচে হলুদ পাতার স্তূপ জমেছে। নাঙা ডালগুলোয় যখন নতুন পাতা আসবে তখন আমি এখানে থাকব না।
সময় ফুরিয়ে এলো। আমি একাই আমার লাগেজগুলো তৈরি করে ফেললাম। মার্সি গত সপ্তাহে মিসিসিপি গেছে। ভাবলাম সে থাকলে হয়তো আমাকে গোছানোয় সাহায্য করত। লাঞ্চের পর ট্যাক্সি নিয়ে আমাকে হিউস্টন এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিতে এলো এরিক ও জোডেল। বিদায় উপহার হিসাবে একটা স্যাম্পেনের বোতলও মিলল তাদের কাছে। যখন মিয়ামি পৌঁছুলাম তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। মাঝরাতে সোভিয়েত বিমান সংস্থা এয়ারোফ্লোতের বিশাল বপু তু-১৪৪ যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলীয় শহর মিয়ামি থেকে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের উদ্দেশ্যে উত্তর আটলান্টিকের আকাশে উড়াল দিল। পেছনে পড়ে রইল যুক্তরাষ্ট্র─আমার প্রবাস জীবনের চারণভূমি। সেখানে হিউস্টন টেকনোলোজিক্যাল ইউনিভার্সিটির এ্যারোনটিকস ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুম, সেমিনার লাইব্রেরি, করিডোরের ব্যস্ততা থাকল। জর্জ ওয়াশিংটন হোস্টেলের একশ’ একত্রিশ নম্বর কক্ষ থাকল। হিউস্টনের কোলাহল থাকল। একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল মিয়ামি শহরের শেষ আলোকবিন্দুটি।
ঘন্টা ঘণ্টা দুই আগে মস্কো থেকে নয়াদিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা করেছে আমাদের বিমান। ক্লান্তিকর দীর্ঘ যাত্রার ধকল সহ্য করতে না পেরে সুমিত্রা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। সামনের সিটের পেছনের পকেটে ভিক্তর মাতসুলেনকোর লেখা ‘দ্য ব্যাটল অব কুরস্ক’ বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ পেলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কীভাবে জার্মান বাহিনীর বিশাল সমর সজ্জাকে রুশ বাহিনী অসাধারণ দেশপ্রেমের জোরে রুখে দিয়েছিল তা নিয়ে লেখা। বইটিতে মূল যুদ্ধের সময় তোলা অনেক ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ লেখনী। আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম; তবু কেন জানি আমার মনোযোগ মাঝে মধ্যেই নড়ে যাচ্ছিল। ঘুরে ফিরে আমার মনে হচ্ছিল মার্সির কথা। সে কি জানে তার জন্যে আরব সাগরের পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উপরে কোন একজনের কষ্টের নদীতে তখন দুকূলপ্লাবী বান ডেকেছে? ঠিক এ মুহূর্তে কী করছে সে? আমার কষ্টের শতাংশও কি আমার জন্যে তার আছে?
সুমিত্রাকে ডাকলাম
─সুমি
ঘুমের ঘোরেই সে জবাব দিল
─কী বল?
─আসার সময় মার্সির সাথে তোমার দেখা হয়েছিল?
─হ্যাঁ।
─আমার কথা কিছু বলল?
─না, শুধু বলল, তোমরা কি এক সাথে যাচ্ছ?
─আর কিছু?
─না।
সুমি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সুমির সাথে হয়তো আর কোনদিনই আমার দেখা হবে না। আর এক ঘণ্টা পরেই ও দিল্লীতে নেমে যাবে। বিমানবন্দরে ওর স্বামীর থাকবার কথা। আমাকেও নামতে হবে। ঢাকাগামী কানেকটিং ফ্লাইটের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে ছ’ঘণ্টা।
চার বছর পরের ঘটনা। সেদিন কিছুটা দেরি করে অফিস থেকে ফিরেছি। শোবার ঘরের টেবিলে ইউ এস পোস্টাল সার্ভিসের সীল দেয়া একটা চিঠি পেলাম। দেশের বাড়ি থেকে মতি চাচা নিয়ে এসেছে। মার্সির চিঠি। আমার স্থায়ী ঠিকানায় লেখা। মার্সি লিখেছে, ওর বাবা ফাদার স্যান্ডোজ বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরের কোন এক গির্জার ভিকার। তাকে খুঁজে বের করে জানাতে হবে, মার্সি তার সাথে দেখা করার জন্যে তেইশ ডিসেম্বর এদেশে আসবে।
আমার কাছে উত্তর পাবার জন্য সে প্রশ্নটি করেনি; তার নির্লিপ্ততায় বিব্রত হয়ে আমি চুপ করে রইলাম।
মার্সির বাবার সাথে দেখা করতে দিনাজপুর গেলাম। কিন্তু তাকে আমি মার্সির বার্তাটা পৌঁছে দিতে পারিনি। মিশন হসপিটাল সংলগ্ন গির্জার ভিকার ফাদার লং ফেলো আমাকে ফাদার স্যান্ডোজের সমাধিতে নিয়ে গেলেন। তার কাছে জানলাম, মিঃ স্যান্ডোজ ছিলেন ইটালিয়ান এবং মিসেস স্যান্ডোজ ফরাসি। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গিয়ে তাদের পরিচয় ঘটে এবং বিয়ে হয়। উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন। দীর্ঘ এক যুগ পরে তাদের সংসার ভেঙে যায়। ছাড়াছাড়ি হবার পর মিসেস স্যান্ডোজ একমাত্র সন্তান মার্সিকে তার বাবার কাছে রেখে চলে যান টেক্সাসে। এক এস্টেটের মালিককে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। পরে তিনি কোন এক অজ্ঞাত কারণে আত্মহত্যা করেন। মিঃ স্যান্ডোজ দশ বছরের মার্সিকে একটা শিশু সদনে রেখে তার নামে সমস্ত বিষয় সম্পত্তি লিখে দিয়ে ধর্ম প্রচারের কাজে বেরিয়ে পড়েন। ভারত, শ্রীলঙ্কা ঘুরে আশির দশকে আসেন বাংলাদেশে। বছর পাঁচেক বসবাসের পর দিনাজপুরে হার্ট এ্যাটাক করে মৃত্যু বরণ করেন তিনি।
মার্সিকে নিতে বিমানবন্দরে গেলাম। নির্ধারিত সময়ের তিন ঘণ্টা পর বৃটিশ এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৪৭ নিউইয়র্কের যাত্রী নিয়ে লন্ডন থেকে ঢাকা এলো। মার্সি ঠিক আগের মতই আছে। ঠিক হিউস্টনে তাকে যেমন দেখেছি তেমন। সেই নিষ্পাপ চোখ। সেই হাসি। সারা অবয়র জুড়ে সেই স্থবির গাম্ভীর্য। শুধু বদলেছে পোশাকটা। ঢাকার তাপমাত্রার সাথে মিল রেখে সে একটা হালকা সাদা গাউন পড়েছে। আর মাথায় নেই অনেক দিনের চেনা সেই হালকা নীল রঙের ক্যাপটি। আমার সাথে কুশল বিনিময়ের পর মার্সি আশপাশে তাকাচ্ছিল। মনে হলো সে তার বাবাকে খুঁজছে। মার্সিকে তার বাবার মৃত্যুর সংবাদটি কীভাবে দেবো সেটি আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভাবলাম প্রত্যাশা জেগে উঠার আগেই তার আকাঙ্ক্ষা টা নিবৃত্ত করি। আমি সাহস করে বললাম
─মার্সি, আমরা গাড়িতে যেতে যেতে তোমার বাবার বিষয়ে আমি যা জানি তা নিয়ে কথা বলব ; ঠিক আছে ?
মার্সি কিছুটা স্বগোতোক্তির মতো করে বলল
─আমি কি আমার বাবার সমাধিটা দেখতে পাব?
আমার কাছে উত্তর পাবার জন্য সে প্রশ্নটি করেনি; তার নির্লিপ্ততায় বিব্রত হয়ে আমি চুপ করে রইলাম। বিমান বন্দরের বাইরে এলাম। মমতা মালপত্রগুলো গাড়িতে তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল।
মার্সি বলল
─হু ইজ সি?
আমি বললাম
─মমতা, মাই ওয়াইফ।
মার্সির চোখ ছলছল করে উঠল। আনন্দাশ্রু না বেদনার জল বোঝা গেলো না।